১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

‘অস্ত্র তাক করলে মনে হতো এই বুঝি জীবন শেষ’

স্বজনদের সাথে এমভি আব্দুল্লাহর ইঞ্জিন ক্যাডেট মো: আইউব : নয়া দিগন্ত -


জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজ এম ভি আবদুল্লাহর ইঞ্জিন ক্যাডেট মো: আইয়ুব গত মঙ্গলবার বাড়ি ফিরেছেন। চট্টগ্রামে জাহাজ থেকে নেমেই বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরেন এম ভি আবদুল্লাহর ইঞ্জিন ক্যাডেট লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের রাখালিয়া গ্রামের মো: আইয়ুব।
গতকাল উপজেলার সোনাপুর ইউপির রাখালিয়া গ্রামের বিনন বেপারি বাড়িতে গিয়ে আইয়ুবকে দেখতে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ ভিড় করে। সকাল থেকে জেলা ও উপজেলার গণমাধ্যমকর্মীরাও ভিড় করেন।

আইয়ুব সাংবাদিকদের বলেন, সোমালিয়ান দস্যুদের কাছে ৩৩ দিন জিম্মি ছিলাম। অস্ত্র তাক করলে মনে হতো এই বুঝি জীবন শেষ, মায়ের কাছে ফেরা হবে না। রাতে ঘুম হয়নি, উদ্বেগ ও আতঙ্কে কেটেছে কয়েকদিন। প্রথমে মাছ ধরার ট্রলারে করে দস্যুরা আসার সময় আমরা তা দেখেছি। তখন আমি ডিউটিতে ছিলাম। সতর্ক অ্যালার্ম বাজানো হয় সবাই সর্তক ছিল; কিন্তু দস্যুদের সাথে মোকাবেলা করার সাহস কারো ছিল না। প্রথমে দস্যুরা আমাদের জাহাজ এম ভি আবদুল্লাহতে প্রবেশ করে সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে একটি রুমে নিয়ে যায়। তিন-চার দিন দস্যুরাসহ সবাই একই রুমে অবস্থান করেছি; কিন্তু থাকা ও খাওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। আমরা রোজা রাখতাম তখন; রমজান মাস ছিল। তাদের বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে ইফতার ও সাহরি খেতে হবে তখন তারা একটু নমনীয় হয়। সুযোগ দেয়া হয় আমাদেরকে নামাজ আদায় করার ও রোজা রাখার।

দস্যুরা আমাদের খাওয়া খেত; কিন্তু তৃপ্তি না পাওয়ায় কয়েকদিন পর তারা দুম্বা নিয়ে আসা শুরু করে। পরে আমাদের খাওয়া বাদ দিয়ে তারা নিজেদের খাবার খাওয়া শুরু করে। পাঁচ-চয় দিন পর দস্যুরা সবাই যার যার দায়িত্ব পালন ও অন্য রুমে যাওয়ার অনুমতি দেয় এবং দ্রুত তারাই আমাদের মালিক কবির গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। আমাদের সাথে ভালো আচরণ ও খোলামেলা কথা বলা শুরু করে। আমাদের জানায়, তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না আমরা। মুুক্তিপণ পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছি। তোমাদের মালিক সাড়া দিয়েছে। তোমরা ইচ্ছা করলে মোবাইলে দেশে কিংবা মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারো। আমরা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতাম। মালিকপক্ষ প্রতিদিন যোগাযোগ করত, তাদের সাথে কথা বলত। ঈদের দিন তারা আমাদের নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়।

আমরা ৩৩ নাবিক নামাজ পড়ার সময় তারা চার দিকে অস্ত্র দিয়ে পাহারা রাখে। প্রতি তিন থেকে চার দিন পর পর তাদের সদস্যরা পরিবর্তন হতো। তবে প্রত্যেকে অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ নিয়ে আসত। মুক্তিপণ পাওয়ার পর তারা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় আমাদের অনেক দুম্বা দিয়ে যায়। গত মঙ্গলবার আইয়ুবের বড় ভাই ওমর ফারুক তাকে রিসিভ করেন চট্টগ্রাম থেকে। রাতেই বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হন; রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাড়ি পৌঁছেন। গতকাল সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে সাংবাদিকরা তার বাড়িতে জড়ো হতে থাকেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আইয়ুব জানান, গত এক বছর ধরে ইন্টার্ন করছেন। এম ভি আবদুল্লাহ জাহাজে আর যাবেন না তিনি। পড়াশোনা বাকি আছে। সেগুলো শেষ করে অন্য জাহাজে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে তার।

আইয়ুবের ভাই ওমর ফারুক জানান, কবির গ্রুপ থেকে গত সোমবার রাতে আমাকে ফোন করে জানান, মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরে আইয়ুব আসবে তাকে রিসিভ করার জন্য আমি গিয়েছি। ভাইকে দেখে ঈদের চেয়ে আনন্দ লাগছে। কারণ ঈদে আনন্দ করতে পারিনি আতঙ্কে ও উদ্বেগের মধ্যে এতগুলো দিন অতিবাহিত করেছি।
আইয়ুবের চাচা হাসেম আলী জানান, খুব খুশি হয়েছি। ছেলেটা আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। মহান আল্লাহর কাছে কতইনা দোয়া করেছি, আল্লাহ রহমত করেছেন।
ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডেট আইয়ুব খান লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের রাখালিয়া গ্রামের বিনন বেপারি বাড়ির মৃত আজহার মিয়ার ছোট ছেলে। তিনি রাখালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও রামগঞ্জের ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া একাডেমি থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন তিনি। প্রায় এক বছর ধরে ইন্টার্ন করছেন আইয়ুব।
গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুরে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এম ভি আবদুল্লাহ। এ সময় শিল্পগ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। জাহাজে লক্ষ্মীপুরের আইয়ুব খানসহ মোট ২৩ নাবিক ছিলেন। পরে মুুক্তিপণের বিনিময়ে ৩৩ দিন পর দস্যুরা তাদের ছেড়ে দেয়। জাহাজের মালামাল বিভিন্ন রাষ্ট্রে সরবরাহের পর ১৪ মে বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে এম ভি আবদুল্লাহ জাহাজ।


আরো সংবাদ



premium cement