দিল্লি বিমানবন্দরে বাংলাদেশী গার্মেন্টের রফতানি বাড়ায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আপত্তি
- বিবিসি
- ০৬ মে ২০২৪, ০০:০৫
ইউরোপসহ নানা দেশে রফতানির জন্য দিল্লি বিমানবন্দরে বাংলাদেশ থেকে আসা তৈরি পোশাকের পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেছে যে ভারতীয় রফতানিকারকরা চাইছেন তাদের পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া হোক।
নিজেদের রফতানি পণ্যের জন্য বাড়তি মাশুল দিয়ে জায়গা নিতে বাধ্য হচ্ছেন, এমনটাও জানাচ্ছেন ভারতীয় রফতানিকারকরা।
বিষয়টি নিয়ে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে ইতিমধ্যেই দু’দফায় আলোচনা করেছেন ভারতীয় রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠনগুলো।
দিল্লি হয়ে রফতানির জন্য বাংলাদেশে গার্মেন্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে। তবে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বিজিএমইএ বলছে যে, ভারতীয় রফতানিকারকদের দাবি খুবই অযৌক্তিক। কারণ বাংলাদেশের গার্মেন্ট রফতানির সামান্য একটা অংশই ভারতের মাধ্যমে যায়। ফলে তাদের পণ্যের কারণে দিল্লি বিমানবন্দরে ‘মালামালের জট’ লাগার কথা না। আগে ঢাকা থেকে কলকাতা বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একটা অংশ রফতানি হতো ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে।
গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল থেকে কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশী গার্মেন্ট রফতানি বন্ধ হয়ে তা চলে যায় দিল্লিতে। সম্প্রতি দৈনিক প্রায় ৩০ ট্রাক ভর্তি বাংলাদেশী গার্মেন্টস পণ্য রফতানির জন্য দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে পৌঁছাচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
ভারতীয় পণ্যের অগ্রাধিকার দাবি- কী বলছে বিজিএমইএ ?
বাংলাদেশী তৈরি পোশাক পণ্যের কারণে দিল্লি বিমানবন্দরে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ভারতীয় রফতানিকারকদের, তার সমাধান হিসেবে ভারতীয় রফতানি পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার দাবি উঠেছে। ভারতীয় রফতানিকারকদের একাংশ থেকে দাবি উঠছে যে, বাংলাদেশী তৈরি পোশাক পণ্য যা দিল্লি বিমানবন্দরের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোতে পাঠানো হচ্ছে, তার ওপরে একটা ‘ল্যান্ডিং চার্জ’ বসানো হোক।
তার ফলে বাংলাদেশী রফতানি পণ্যের ওপরে বাড়তি মাশুল চাপবে, এতে ভারত হয়ে বাংলাদেশী পণ্য রফতানি কমবে। কিন্তু এর সাথে একমত নন অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি।
তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশী পণ্যের ওপরে ল্যান্ডিং চার্জ লাগালে তাতে ভারতীয় রফতানিকারকদের কোনো সুবিধাই হবে না। এতে বাংলাদেশী রফতানিকারকদের বাড়তি খরচ হবে, কিন্তু তাতে আমাদের তো কোনো লাভ নেই। ওই ল্যান্ডিং চার্জ তো যাবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে।’ ‘আমরা সরকারের সাথে দুই দফায় আলোচনা করেছি। যেটা সরকারের করা উচিত, তা হলো পরিকাঠামো উন্নত করা, পণ্যবাহী বিমান ভারতে আসার ব্যাপারে যেসব নিয়ন্ত্রণ চালু আছে, সেগুলো তুলে নিয়ে আরো বেশি বিমান এখানে আসার ব্যবস্থা করা।
আর যতক্ষণ না সেটা করা যাচ্ছে, ততক্ষণ বাংলাদেশী রফতানি পণ্যের ওপরে একটা লাগাম টানা দরকার, বলছিলেন মি. সেখরি। এ দিকে, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বিজিএমইএও ভারতীয় রফতানিকারকদের মতোই প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, দিল্লি বিমানবন্দরের পরিকাঠামো উন্নত করলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বিবিসি বাংলার তারেকুজ্জামান শিমুলকে বলেছেন, ‘আমার জানামতে, বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যের সামান্য কিছু অংশ ভারত হয়ে যায়। কিন্তু তার জন্য ভারতীয়দের পণ্য রফতানিতে সমস্যা হবে বা এয়ারপোর্টে মালামালের জট লেগে যাবে, সেটি হওয়ার কথা না।
কিন্তু বাস্তবে যদি এমনটি সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর এক্সট্রা ল্যান্ডিং চার্জ বসানোর দাবি না তোলে, বরং তাদের উচিত বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে কথা বলা।’
বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের সাথে কথাবার্তা হলেও এখনো তা চূড়ান্ত পর্যায় যায়নি ভারতে চলমান নির্বাচনের কারণে। তবে ভারতীয় রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের সহসভাপতি ইশরার আহমেদ বলছিলেন, ‘অবশ্যই ভারতীয় পণ্যই রফতানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।’
আমরা সরকারের সাথে কথাও বলছি। তবে এখন নির্বাচন চলছে। আমরা আশাবাদী যে নির্বাচন মিটলে এর একটা সমাধান বেরবে। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনসের সহ সভাপতি ইশরার আহমেদ বলেছেন, সমস্যা শুরু হয় গত বছরের গোড়া থেকে। মি. আহমেদ ব্যাখ্যা করছিলেন, ‘লোহিত সাগরের সমস্যা ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়ার পরে দিল্লি বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশী তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ বাড়তে থাকে।
এ বছরের প্রথম তিন মাসে, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দিল্লি বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন পণ্য রফতানি করা হয়েছে - যার ৯ শতাংশই বাংলাদেশের পণ্য।’
এর আগে গত বছর মানে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দিল্লি বিমানবন্দর হয়ে যত পণ্য রফতানি হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশী পণ্যের পরিমাণ ছিল দুই শতাংশেরও কম। লোহিত সাগর অঞ্চলের সমস্যার কারণে ভারতীয় অনেক রফতানিকারকও বিমানে পণ্য পাঠাতে চেষ্টা করছেন, আবার এর সাথে বাংলাদেশ থেকেও রফতানির জন্য বেশি পরিমাণে পণ্য আসছে।
এই দুইয়ে মিলে দিল্লি থেকে ভারতীয় রফতানিকারকদের বাড়তি মাশুল দিয়ে কার্গো বিমানে জায়গা নিতে হচ্ছে।
ভারতের পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশান কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি বিবিসি বাংলাকে জানাচ্ছিলেন, ‘লোহিত সাগরের বদলে এখন পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে কেপ অব গুড হোপ ঘুরে ইউরোপ যেতে হচ্ছে। এর ফলে ১০-১২ দিন বাড়তি সময় লাগছে জাহাজে। অনেক ব্র্যাণ্ডই তাই আকাশপথে পণ্য রফতানি করতে চাইছে।’ তার কথায় এর আগে গত বছর থেকে যখন বাংলাদেশী গার্মেন্ট দিল্লি হয়ে রফতানি হতো, তখন এই সমস্যা হয়নি।
যে কারণে দিল্লি দিয়ে বাংলাদেশী পোশাক রফতানি বাংলাদেশ থেকে দিল্লির মাধ্যমে তৈরি পোশাক রফতানি শুরু হয় গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। তার আগে বাংলাদেশী গার্মেন্টের একটা অংশ রফতানি করা হতো কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে। কলকাতার এক তৈরি পোশাক রফতানি সংস্থা রাধামনি ইন্ডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সন্দীপ পোদ্দার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘আগে ঢাকা থেকে সড়ক পথে কলকাতায় এসে এখান থেকে বিমানে বা জাহাজে বাংলাদেশী গার্মেন্ট রফতানি করা হতো।
এখন কাতার বা এমিরেটস-এর মতো বিমান সংস্থা কার্গো বিমান কলকাতায় পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য দিকে, দিল্লি অনেক বড় বিমানবন্দর, সেখানে সব বিমান সংস্থার পণ্যবাহী বিমানই আসে, ব্যবস্থাপনাও ভালো সেখানে।
দিল্লি বিমানবন্দর বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের সুবিধাজনক দরে পণ্য রফতানির প্রস্তাব দেয়। তাই বাংলাদেশী সংস্থাগুলো দিল্লি চলে যায় - ব্যাখ্যা করেন মি. পোদ্দার।
তবে গোটা বন্দোবস্ত দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে ভারত সরকারের একটা নীতিও কাজ করেছে বলে জানাচ্ছিলেন, ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনসের সহ সভাপতি ইশরার আহমেদ।
তিনি বলেন, ভারতের বিমানবন্দরগুলোকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব-এ পরিণত করার নীতি অনুযায়ী গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এখান থেকে বাংলাদেশী তৈরি পোশাক রফতানি শুরু হয়।
গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দিল্লি বিমানবন্দর থেকে ২৬০ হাজার টন পণ্য রফতানি হয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশী পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের পরিমাণ ছিল মাত্র পাঁচ হাজার কিলোগ্রাম, যা দুই শতাংশেরও কম।
“যখন থেকে লোহিত সাগর অঞ্চলে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তখন থেকে দক্ষিণ এশিয়ার এমন অনেক রফতানি পণ্যই সমুদ্রপথ ছেড়ে আকাশ পথ ধরেছে। এর মধ্যে ফাস্ট ফ্যাশন সংস্থাগুলো বিশেষ করে বিমানে করে তাদের পণ্য রফতানি করছে,’ বলছিলেন মি. আহমেদ।
পোশাক শিল্পে ‘ফাস্ট ফ্যাশন’-এর অর্থ হলো পশ্চিমা দেশগুলোর ফ্যাশন শোয়ে প্রদর্শিত পোশাকের খুব দ্রুত নকল বানিয়ে কম খরচে সাধারণ মানুষের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর বাজারে নিয়ে আসার ব্যবসা।