১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দক্ষিণাঞ্চলে পানি উঠছে না গভীর নলকূপেও

-

- ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের নদীগুলোর আয়ু অনেক কমিয়েছে
- ব্যবহারিক কাজে ভূমির উপরিতলের পানি ব্যবহারের পরামর্শ

বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় অনেক এলাকায় গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না। পানির লেয়ার বা স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার ছয় লাখ মানুষের জন্য দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছিল তিন কোটি ২০ লাখ লিটারের। ভূগর্ভের পানি সরবারহের এই উৎস সিটি এলাকার অর্ধেক মানুষের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট দু’টি চালু না করতে পারায় ব্যক্তি পর্যায়ে গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমতি দেয় নগর ভবন। ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সাড়ে চার হাজারের অধিক গভীর নলকূপ বসানোর অনুমতি দেয়া হয়। বিপত্তি বাধে অন্যত্র। গ্রীষ্মকাল এলে নলকূপে পানি ওঠে না গত তিন বছর ধরে। যে কারণে বাধ্য হয়ে এবার সাবমারসিবল পাম্প স্থাপনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশন বলছে, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু থাকলে পানি উত্তোলনের হিসেব থাকত। ব্যক্তিপর্যায়ে সাবমারসিবল পাম্প বসানোয় কত কোটি লিটার পানি উত্তোলিত হচ্ছে তার হিসেব নেই।
এর বিপরীত চিত্র বরগুনা জেলার উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটায়। বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা পাথরঘাটা পৌরসভার বাসিন্দা ৩০ হাজার। নদী, জল-জলাশয় বেষ্টিত এখানে এক গ্লাস নিরাপদ পানির জন্য সংগ্রাম করতে হয়।
পাথরঘাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হোসেন আকন বলেন, পৌরসভার বাসিন্দারা ডিপ টিউবয়েল বসিয়েও খাবার পানি তুলতে পারেন না। টিউবয়েলের পানি এত বেশি লবণাক্ত যে মুখে দেয়ার কোনো উপায় নেই। পৌরসভা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে ভূগর্ভের একটি উৎস থেকে পানির লাইন করে পৌরবাসীর জন্য সরবারহ করা হয়। যদিও তাতে পানির অভাব পূরণ হয় না। লোডশেডিংয়ের কারণে যথাসময়ে পানি লাইনে দিতে পারি না।
বরিশাল সিটি করপোরেশন বা পাথরঘাটা পৌর শহরই কেবল নয়, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বরগুনায় সুপেয় পানির জন্য শঙ্কা দেখা দেয় শুকনো মৌসুম এলেই। অথচ শত শত নদী-খাল মাকড়সার জালের মতো এসব জেলার বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে। যে কারণে বরিশালকে জলের দেশও বলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত ভোলা জেলায় পানির কোনো সঙ্কট দেখা দেয়নি।
নিচে নেমেছে পানির স্থিতিতল
গভীর নলকূপ স্থাপনের মিস্ত্রি হরগোবিন্দা সাহা বলেন, বরিশাল শহর ও শহর লাগোয়া কাশিপুর, চরকাউয়া, রায়পাশা-কড়াপুর, জাগুয়া, চরবাড়িয়া ইউনিয়নে পাঁচ বছর আগেও ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীরতায় সুপেয় পানির স্থিতিতল পাওয়া যেত। যা বর্তমানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৪০ ফুট গভীরে। যেসব এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ এবং গভীর নলকূপ বেশি রয়েছে সেই সব এলাকায় পানির স্তর পেতে অনেক গভীরে যেতে হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার ৪২টি উপজেলার মধ্যে ১৫০টিরও বেশি গ্রামে সুপেয় পানির সঙ্কট রয়েছে। এ ছাড়া পৌর শহর, সিটি করপোরেশন এলাকায় তো রয়েছেই।
সুপেয় পানির জন্য কাজ করা উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশনের বরিশাল জোনের প্রধান বাদল হাওলাদার জানান, এখন পর্যন্ত পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ও বরগুনার পাথরঘাটায় আমরা দুটি প্রকল্পে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছি। ৩৫টি প্ল্যান্টে প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানি নিতে পারছে।
পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ইকরি ইউনিয়নের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, ফাল্গুন মাস এলেই আমাদের টিউবওয়েলের পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস এলে আবার স্বাভাবিক হয়। এ নিয়ে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি সাবমারসিবল বসাতে বলেছেন। মাটির নিচের খাবার পানির স্তর নিচে নেমে গেছে বলে জানিয়েছেন। পাশের উপজেলা মঠবাড়িয়ার সাপলেজা ইউনিয়নের ঝাটিবুনিয়া গ্রামের মিরাজ মিয়া বলেন, চৈত্র মাস এলে পুকুর খালের পাশাপাশি টিউবওয়েলের পানিও শুকিয়ে যায়। এ জন্য প্লাস্টিকের গ্যালন কিনেছি। বৃষ্টির সময়ে পানি ধরে রাখি। আবার পুকুরের পানি ফুটিয়েও পান করি।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার মঠবাড়ী ইউনিয়নের পারভীন বেগম বলেন, টিউবওয়েলের পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাবমারসিবল বসিয়ে নিয়েছি। এখন আর পানির অভাব নেই। মাহমুদ হাসান নামে পটুয়াখালীর এক স্বেচ্ছাসেবী বলেন, পৌর শহরে পানির সঙ্কট প্রকট। পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের পাম্পে পানি উত্তোলন করলে ১ নং ওয়ার্ডের টিউবওয়েলগুলোতে পানি ওঠে না। এজন্য পৌর কর্তৃপক্ষ রাতে পানি তোলে আর বাসিন্দারা দিনে। দিনে দিনে বিভিন্ন কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
দক্ষিণাঞ্চলে পানির সঙ্কট যে কারণে?
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বরিশাল বিভাগীয় অধিদফতর জানিয়েছে, ফসলের ক্ষেতে সেচের জন্য বিভাগের ছয় জেলায় ৭৫২টি পাম্প রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় ২২২টি, ভোলায় ১৮৪টি, পিরোজপুরে ১০৩টি, ঝালকাঠিতে ৬৫টি, পটুয়াখালীতে ১১৮টি ও বরগুনায় ৬০টি। সরকারি এই পাম্পগুলোর সবগুলোই মাটির উপরি ভাগের পানি সঞ্চালনের জন্য ব্যবহৃত বা সারফেস ওয়াটার পাম্প। দক্ষিণাঞ্চলে সাধারণত গ্রাউন্ড ওয়াটার পাম্পের প্রয়োজন পড়ে না। তার পরও অনেকে নিজের সুবিধার জন্য গ্রাউন্ড ওয়াটার পাম্প ব্যবহার করেন তা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন অনুমোদিত নয় বা তার তথ্যও এই অধিদফতরের হাতে নেই।
বিএডিসি বরিশাল জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ ওয়াহিদ মুরাদ বলেন, সেচ পাম্পগুলো সাধারণত ভূগর্ভের পানি ব্যবহার করে না। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ের গভীর নলকূপ, সাবমারসিবল পাম্প ভূগর্ভের পানি তুলছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক মনে করেন, শুধু ভূ-গর্ভস্থ পানি তোলাই কারণ নয়, আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে ফারাক্কা বাঁধ। তিনি বলেন, ভূ-গর্ভস্থ পানির যে রিসোর্স এটা শেষ হয়ে যেতে পারে এগুলো মানুষ বিবেচনা করে না। গত ২০-৩০ বছরে দক্ষিণাঞ্চলের নদী-খালগুলোর গভীরতা কমে গেছে। বাংলাদেশর ভাটি এলাকার জনপদ। উজান থেকে যে পানি আসত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে তা জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে ফারাক্কা বাঁধ করে। সুতরাং সুপেয় পানির জন্য যে হাহাকার চার দিকে শুরু হয়েছে সেই পরিস্থিতির জন্য সর্বপ্রথম দায়ী ফারাক্কা বাঁধ। নদীগুলো শুকিয়ে গেছে, নাব্যতা হারিয়েছে, নদীর ক্যাচমেন্ট ফ্লো নষ্ট করে দিয়েছে ফারাক্কা বাঁধ। ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার পর এই ৫০ বছরে আমাদের নদীগুলোর যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, পদ্মা, যমুনার মতো নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। ফারাক্কা না থাকলে এমন অবস্থায় যেতে আমাদের অন্তত ৭০০ বছর লাগত। তার মানে যা আমাদের ৭০০ বছরে হতো একটি বাঁধ সেখানের সাড়ে ৬০০ বছরের আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিয়েছে। ফারাক্কার কারণে আমাদের সারফেস ওয়াটার রিসোর্স ধ্বংস হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, মানুষ সব কাজে গ্রাউন্ড ওয়াটার বেশি ব্যবহার করছেন। কিন্তু সেই তুলনায় রিচার্জ হচ্ছে না। যে কারণে গ্রাউন্ড ওয়াটার নিচে নেমে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
ড. হাফিজ আশরাফুল হক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সুপেয় পানির জন্য দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ একটি বিপর্যয়ের কাছাকাছি রয়েছে। তিনি সব কাজে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার না করে শুধু খাওয়ার জন্য এই পানি ব্যবহার করার পরামর্শ দেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বরিশাল জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ইমরান তরফদার বলেন, নদী-খাল ও জলাধার বেষ্টিত বরিশাল বিভাগে সুপেয় পানির সঙ্কট বাড়ছে এটি দুঃখজনক। এই সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে এলে ব্যবহারকারীরাই দায়ী। শিল্প কারখানা, কৃষিজমি, দৈনন্দিন সব কাজে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পানির সঙ্কট দেখা দেয়। তিনি বলেন, সব কাজে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার করে সুপেয় পানি পাওয়ার সঙ্কট আমরাই তৈরি করছি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বরিশাল সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, তিন-চার বছর ধরে গ্রীষ্মকাল এলেই বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে সুপেয় পানির সঙ্কট দেখা দেয়। ভূগর্ভের পানির স্থিতিতল নিচে নেমে যাওয়ায় এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এজন্য গভীর নলকূপেও সহজে পানি উঠানো যাচ্ছে না। যেসব এলাকায় এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে সেখানে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হচ্ছে। কারণ অনেক স্থানে পানির হার্ডলেয়ার দেখা দেয়। বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়া আসলে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও বর্ষা মৌসুম এলে পানির স্থিতিতল উপরিভাগে উঠে আসে। তখন সমস্যা লাঘব হয়।


আরো সংবাদ



premium cement
দেলদুয়ারে বিজয় দিবস উপলক্ষে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ভালুকায় সড়ক দুর্ঘটনায় সিএনজিচালক নিহত বরখাস্ত সিপাহী শাহীন বাহিনী সম্পর্কে অপপ্রচার করছেন : বিজিবি সব কোচের সাথে যেন সমান বিচার করা হয় : বার্সেলোনা কোচ বিজয় দিবসে শিশু পার্কে বিনা টিকিটে প্রদর্শনীর নির্দেশ লাউয়াছড়া বনে পাহাড়িকার চার বগি বিচ্ছিন্ন খুলনায় হাসিনা ফিরে আসার ভিডিও, তদন্তে ৪ সদস্যের টিম বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানিতে আগ্রহী পাকিস্তান আরএনপিপিতে শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি অনুসন্ধানে রুল আধিপত্যবাদমুক্ত একটি ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র উপহার দিবে জামায়াত : গোলাম পরওয়ার বিদেশে চিকিৎসায় বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে বাংলাদেশ : গভর্নর

সকল