সারা দেশে যাচ্ছে দামপাড়া গ্রামের তালপাতার পাখা
- মো: আল আমিন কিশোরগঞ্জ
- ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৮
বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি এমন দুর্গম গ্রামে কিংবা লোডশেডিংগ্রস্ত শহুরে জীবনে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয় হাতপাখা। তালপাতার তৈরি এই হাতপাখার সাথে জড়িয়ে আছে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দামপাড়া গ্রামের প্রায় দুই শ’ পরিবারের জীবন-জীবিকা।
এখানকার হাতপাখা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়। প্রতি বছরের চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে তালপাতার পাখার চাহিদা বেড়ে যায়। তখন নিকলীর দামপাড়া গ্রামের নোয়ারহাটি, টেকপাড়া ও বর্মনপাড়ায় ঘরে ঘরে পাখা তৈরির ধুম পড়ে যায়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কারিগররা বাড়ির উঠানজুড়ে দলবেঁধে হাতপাখা তৈরির কাজ করেন। তবে এই তিন মাসের তালপাতার পাখার বাজারকে কেন্দ্র করে কারিগররা ব্যস্ত থাকেন বছরের অন্য সময়ও। এবার লোডশেডিং বেশি থাকায় এবং প্রচণ্ড গরমের কারণে তালপাতার পাখার চাহিদাও বেড়েছে। সারা দেশে যাচ্ছে দামপাড়া গ্রামের প্রাণজুড়ানো দেহ শীতল করার এই তালপাতার হাতপাখা ।
গতকাল সোমবার সরেজমিন দামপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সেখানে এখন তালপাতার পাখা বানানোর ধুম লেগেছে। ছেলে, বুড়ো, কিশোর, কিশোরী, বসে নেই কেউ। ঘরের বউ-ঝিয়েরা তালের পাতাগুলো দা দিয়ে ফালি করে বেতি করছেন। এগুলো বুনন করে কেউ ছাঁটাই আকৃতি করে নিচ্ছেন। কেউ মোড়ল বাঁশ কেটে, ছেঁটে হাতল তৈরি করে দিচ্ছেন। কেউ প্লাস্টিকের বেত ও সুতা দিয়ে জালি বেতের সাথে ছাঁটাই বা ছাঁচ সেলাই করে হাতপাখার আকৃতি দিচ্ছেন। কেউ বসেছেন রঙের তুলি নিয়ে। আর এই কাজগুলো করা হচ্ছে দলবেঁধে। ঘরের বারান্দায় কিংবা বাড়ির উঠোনে গাছের ছায়ায় বসে।
কথা হয় গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক নারী আশুলতা রায়ের (৮০) সাথে। তিনি জানান, ৬০ থেকে ৭০ বছর ধরে এ গ্রামে তালপাতার পাখা তৈরি হচ্ছে। ১২ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। শাশুড়ির হাত ধরে তিনি তালপাতার পাখা তৈরির কাজ শিখেন।
আশুলতা বলছিলেন, ‘গ্রামে প্রথম আমরার এই ঘরে (নিজদের ঘর দেখিয়ে) আমার শাশুড়ি তালপাতার পাখা বানাইত। শাশুড়ির কাছ থেকে আমি শিখছি। আমার কাছ থেকে পরে গ্রামের এ, হে, সবাই শিখছে। এহন আমার বয়স অইছে, পারি না। আমার বউয়াইনে এবং নাতি-নাতকররা এহন তালপাতার পাখা বানায়।’ গ্রামের ভানুমতি সূত্রধর (৭৮) বলেন, ‘৫০-৬০ বছর ধইরা অইবো আমরা হাতপাখা তৈরির কাজ করতাছি। ৭১ সালে এই গ্রামে পাকবাহিনী আক্রমণ করে। তহন আমাদের অনেকের স্বামীরে মাইরা ফালায়। আমরা বিপদে পইরা যাই। তহন কী কইরা চলবাম। এই কাজ কইরাই আমরা সংসার চালায়া আইতাছি। এহন আমার পুতের বউ, নাতিরাও এই কাজ করে।’
তালপাতার পাখা যেভাবে বানানো হয় : গাছ থেকে তালপাতা এনে শুকিয়ে নির্দিষ্ট মাপে কেটে নিতে হয়। এরপর বেতির মতো করে এগুলো দিয়ে বুনন করে ছাঁচ তৈরি করা হয়। চক্রাকার ছাঁচের চারদিকে জালি বেত ঘুরিয়ে এর ওপর প্লাস্টিকের রিবন পেঁচানো হয়। পাখার হাতল বানানো হয় মোড়ল বাঁশ কেটে ফালি করে। এরপর সেলাই করা হয় নাইলন সুতা দিয়ে। হাতলে প্লাস্টিকের সরু পাইপ কেটে চুঙ্গি দেয়া হয়। এভাবেই তৈরি হয় হাতপাখা।
গ্রামের বিধবা বেদনা রানী সূত্রধর বলেন, ‘এই হাতপাংখার কাজ কইরাই আমরার সংসার চলে। অনেকেই আগের থেকে এই কাজ করতাছে, আমি ৫০ বছর ধইরা করতাছি। মনে করুইন পাখার কাজ কইরা কোনোরহম চলতাছি। এক মেয়ে বিয়া দিছি। দুই মেয়ে ঘরঅ আছে। এদের নিয়া ভালোই আছি।’
গ্রামে তালপাতার পাখা তৈরির কাজটা করেন মূলত নারীরাই। পুরুষরা শুধু সরঞ্জাম এনে দেন। বাড়ির শিশুসন্তানেরা উঠানে বসে নারীদের হাতপাখা তৈরির কাজে সহযোগিতা করে। পাকিস্তান আমল থেকে এখানকার কারিগররা হাতপাখা তৈরি করে জীবিকা চালাচ্ছেন। তিন পুরুষ ধরে এ পেশায় সংসার চালাচ্ছেন গ্রামবাসী। বংশপরম্পরায় এ গ্রামে এখনো কিশোর তরুণ বয়সীরা পাখা তৈরির পেশা বেছে নিচ্ছে।
গত রোববার দামপাড়া গ্রামে বর্মনপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, বড়দের পাশাপাশি অনেক শিশুও তালপাতার পাখা তৈরির কাজ করছে। এদের একজন অঙ্কিতা বর্মন (৯)। সে স্থানীয় বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। অঙ্কিতা বলল, ‘পড়ালেখার ফাঁকে বাবা মাকে আমরা তালপাতার পাখা বানানোর কাজে সহযোগিতা করি। এতে আয় হয়। খাতা কলম কিনে দেয় বাবা।’
গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা আশুলতা রায়সহ বয়স্ক অনেকেই বলছিলেন- বাংলাদেশ হওয়ার অনেক আগে থেকেই দামপাড়া গ্রামে তালপাতার পাখা বানানো শুরু হয়। বাড়িতে শখের বসে আশুলতার শাশুড়ি (স্বর্গীয়) হেমলতা রায় প্রথমে তালের পাতা দিয়ে পাখা বানানো শুরু করেছিলেন। বাড়ির অতিথি সেবায় এই তালপাতার পাখা ব্যবহার করা হতো। তার কাছ থেকেই গ্রামের অন্যরা তালপাতার পাখা বানানো শিখেন। বর্তমানে গ্রামের ২০০ পরিবারের প্রায় এক হাজার মানুষ এই তালপাতার পাখা তৈরির কাজে জড়িত।
গ্রামের তালপাতার পাখার কারিগর লিপি রায় (৪০) জানান, তিনি তার শাশুড়ির কাছ থেকে পাখা বানানোর কাজ শিখেন। তাদের পরিবারের এটাই এখন একমাত্র পেশা।
তালপাতার পাখার কারিগর বিভা রায় বলেন, পরিবারে ছেলেমেয়ে নিয়ে তারা এখন পাঁচজন মানুষ। ছেলেমেয়ের পড়ালেখা, পরিবারের সবার খাদ্য সংস্থান, পোশাক-আশাক ও ওষুধপত্রের টাকা এ তালপাতার পাখা বিক্রি থেকেই তাদের জোগাড় করতে হয়।
গ্রামের প্রবীণ কারিগররা জানান, স্বাধীনতার আগে একটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ত আট আনা। বিক্রি হতো এক থেকে দেড় টাকায়। এখন একটি পাখা তৈরিতে গড়ে খরচ পড়ে ৫০ টাকা। বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৭৫ টাকা টাকায়।
গ্রামের কারিগর বিমলা সূত্রধর (৪৫) বলেন, ‘একটা পাংখা তৈরি করতে ৫০ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ৭০ টাকা। পাখা বিক্রি করতে বাজারে নেয়া লাগে না। পাইকাররা বাড়িত থেকে আইসাই নিয়া যায়।’
গ্রামের দিবা রানী রায় (৫৫) বলেন, ‘এক সময় পাংখা তৈরি করে ভালোই লাভ হইত। এহন পাংখা তৈরির জিনিসের দাম বাইড়া গেছে। একটা তালের পাতার দাম আগে ছিল দশ টাকা, এহন ৪০ টাকা। আগে একটা বাঁশের দাম ছিল ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, এহন ২০০ টাকা দিয়াও কিনন যায় না। এছাড়া প্লাস্টিক, সুতা, চিকন পাইপ, মজুরি সবকিছুর দাম বাড়তি। আগে পাংখা তৈরি করে যেভাবে পোষায়তো এহন আর সেভাবে পোষায় না।’
কারিগররা জানান, একসময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তখন গরমে হাতপাখাই ছিল গ্রামের মানুষের ভরসা। এখন বিদ্যুৎ-জেনারেটর-আইপিএসসহ নানা যান্ত্রিকতার দাপট বেড়েছে। তবে কমেনি হাতপাখার কদর। এখনো গ্রাম-শহর দুই জায়গাতেই হাতপাখার বাজার রয়েছে। এই বাজার ধরে রাখতে এখন হাতপাখায় নানান রঙের নকশা ও জরি ব্যবহার করা হয়। পাখার কারিগর মনসা বর্মন (৪২) বলেন, ‘একটা পাংখা বানাইতে প্লাস্টিক লাগে, জালি বেত লাগে, তালপাতা লাগে, এরপরে বাঁশ লাগে, চুঙ্গি লাগে। এসব দিয়ে তৈরি করতে হয়। সবশেষে রঙ দেওন লাগে। রঙ না দিলে বেশি সুন্দর হয় না তাই বেশি চলে না।’
জানা গেছে, এ গ্রামের কারিগররা একসময় আশপাশের বিভিন্ন বাজার ও মেলায় হাতপাখা বিক্রির জন্য নিয়ে যেতেন। এখন আর সেটা করতে হয় না। পাখাগুলো রঙ-চঙে ও সুন্দর হওয়ায় বিভিন্ন জায়গার পাইকাররা বাড়ি থেকে এসে হাতপাখা কিনে নিয়ে যান। তবে বিদ্যুতের পাখার ভিড়ে সারা দেশে ঐতিহ্যের হাতপাখা হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই দামপাড়া গ্রামের তালপাতার পাখা টিকে রয়েছে। তবে বাঁশ, বেত, তালপাতার দাম বেড়ে যাওয়ায় হাতপাখা তৈরি করে এখন আর পোষাচ্ছে না কারিগরদের। এ অবস্থায় তাদের সংসারে যেমন টান পড়েছে, ঐতিহ্যের এ পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না এ নিয়ে তারা কিছুটা শঙ্কিতও।
তালপাতার পাখার কারিগর অলকা রায় বলেন, ‘আমরার গ্রামে এই পেশায় ২০০ পরিবার জড়িত। আমরার অন্য কোনো পেশা নাই। অন্য কোনো কাজ পারিও না। বাপ-দাদার এই পেশাটাই আমরা ধইরা রাখছি। পাংখা বানানোর জিনিসপত্রের দাম এহন অনেক বাইড়া গেছে। এগুলো জোগাড় করতে অনেকেই ঋণগ্রস্ত। সরকার যদি সুদ ছাড়া আমরারে ঋণ দিতো তাইলে অনেক উপকার হইত।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা