নিজে বাঁচার আগে অন্যকে বাঁচাতে চেয়েছিল দগ্ধরা
সিঁড়ির নিচে গ্যাসের পাইপলাইনের সন্ধান; ৯ জনের কেউই আশঙ্কামুক্ত নন; কর্মসংস্থান দাবি ক্ষতিগ্রস্ত স্বজনদের- কামাল উদ্দিন সুমন নারায়ণগঞ্জ
- ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:০৩
সুমধুর কণ্ঠে প্রতি ওয়াক্তে আজান দিতেন মোয়াজ্জিন হাফেজ দেলোয়ার হোসেন ভুঁইয়া (৪৭)। গত ২৫ বছর ধরে তিনি ফতুল্লার তল্লার এলাকা বায়তুস সালাত জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন-কাম-ইমাম ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নিজে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পরও অন্যদের বাঁচাতে তিনি মরিয়া হয়ে পড়েন। বিস্ফোরণে তার চামড়া ঝলসে যাওয়ার পরও তিনি অন্যদের উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই মারা গেলেন। ওই ঘটনায় মারা গেছে তার ছেলে জোনায়েদও।
মসজিদের ইমাম নিহত আব্দুল মালেকের বড় ছেলে ফাহিদ নয়া দিগন্তকে জানান, মসজিদের মোয়াজ্জিন নিহত দেলোয়ার নিজে একাই অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় দু’জন আহতকে মসজিদ থেকে বের করেছেন এবং পরেও আহত অন্য মুসল্লিদের খবর নিয়েছেন।
একই ঘটনায় বিস্ফোরণে নিজে আহত হয়ে অন্যদেরকে বাঁচাতে বলেছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অফিস সহায়ক মো: শামীম হাসান। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেননি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণে শামীম হাসান আহত হন। কিন্তু তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমার কিছু হয়নি। যারা আহত হয়েছে তাদের বাঁচান। তাদের হাসপাতালে নেন। পরে শামীম হাসান বাসায় গিয়ে কাপড় পরিবর্তন করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যান। কিন্তু সেখানেই তিনি মারা যান। শুক্রবার ফতুল্লা তল্লা এলাকায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজের পর বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
লিকেজ খুঁজছে তিতাস : মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্যাস লাইনের পাইপে আরো লিকেজ খুঁজতে দ্বিতীয় দিনের মতো কাজ করেছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের শ্রমিকরা মাটি খোঁড়ার কাজ করেন। মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দিকে আরো দুটি পয়েন্টে তিতাসের পাইপ বের করার চেষ্টা করছেন তারা।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল ওহাব তালুকদার জানান, সোমবার মাটি খুঁড়ে মসজিদের উত্তর পাশে দু’টি লিকেজ পাওয়া গেছে। আরো কোনো লিকেজ আছে কি-না সেটি খতিয়ে দেখতে দ্বিতীয় দিনের মতো খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।
এ দিকে বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে চতুর্থ দিনের মতো পশ্চিম তল্লা ও আশপাশের এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।
কর্মসংস্থানের দাবি নিহতদের স্বজনদের : গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বোমওয়ালার মাঠে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে বিস্ফোরণে নিহতদের স্বজনরা তাদের দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে কথা বলেন। ওই সময় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান ও জেলা প্রশাসকসহ স্বেচ্ছাসেবীকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
নিহত আহতদের স্বজনদের হয়ে অগ্নিদগ্ধে নিহত মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা আব্দুল মালেকের বড় ছেলে ফাহিদ ইসলাম দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের পক্ষ থেকে দাবি করেন, বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরা উপার্জনশীল ব্যক্তিকে হারিয়েছে। এ ঘটনায় যারা মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই দিন আনে দিন খায়। তাই আমাদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেন প্রত্যেকটি পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন অথবা হাইকোর্টে হতাহতদের পরিবারের পক্ষ হয়ে প্রত্যেক পরিবারের জন্য ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করা হয়েছে সেটি বাস্তবায়ন করা হোক। এ সময় সেখানে হতাহতদের স্বজনরা অঝোরে কাঁদছিলেন। ফলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। হতাহতদের স্বজনদের মধ্যে সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন- নিহত সাব্বিরের মা পারুল বিবি, কুদ্দুস বেপারির মেয়ে সোমা, সাংবাদিক নাদিমের ছেলে নাসির আহমেদ প্রমুখ।
৯ জনের কেউই আশঙ্কামুক্ত নন : মসজিদে বিস্ফোরণে আহত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা: পার্থ সংকর পাল বলেন, ‘এ ঘটনায় বর্তমানে ৯ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে আটজনই আইসিইউতে ভর্তি। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তবে ৯ জনের কেউই আশঙ্কামুক্ত নন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৯ জন হচ্ছেন- ফরিদ (শ্বাসনালীসহ ৫০ শতাংশ পোড়া), শেখ ফরিদ (শ্বাসনালীসহ ৯৩ শতাংশ পোড়া), মো: কেনান (শ্বাসনালীসহ ৩০ শতাংশ পোড়া), নজরুল ইসলাম (শ্বাসনালীসহ ৯৪ শতাংশ পোড়া), সিফাত (শ্বাসনালীসহ ২২ শতাংশ পোড়া), আবদুল আজিজ (শ্বাসনালীসহ ৪৭ শতাংশ পোড়া), হান্নান (শ্বাসনালীসহ ৮৫ শতাংশ পোড়া এবং ডায়াবেটিসের রোগী), আবদুল সাত্তার (শ্বাসনালীসহ ৭০ শতাংশ পোড়া) এবং আমজাদ (শ্বাসনালীসহ ২৫ শতাংশ পোড়া)।
অগ্নিদগ্ধ সালমার পাশে টিম খোরশেদ : এ দিকে এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ সালমা বেগমকে চিকিৎসার জন্য সালমার মেয়ের হাতে টিম খোরশেদ ও টাইম টু গিভের পক্ষ থেকে ৫০০০ টাকা তুলে দেন টিম লিডার কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। বিস্ফোরণের সময় সালমা বেগম মসজিদের সামনের রাস্তা দিয়ে স্বামীর জন্য ওষুধ কিনতে স্থানীয় ফার্মেসিতে যাচ্ছিলেন। সে সময় আগুনে ঝলসে যায় তার শরীরের অর্ধেকাংশ। ওই অবস্থায় তাকে ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। মূলত নারী ও মসজিদের বাইরে অগ্নিদগ্ধ হওয়ায় সালমা সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় কোনো অনুদান বা সহায়তা পাচ্ছিলেন না।
হতাহতদের পরিবারের পাশে নিপুন রায় চৌধুরী : নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকায় মসজিদে বিস্ফোরণে নিহত ও আহত মুসল্লিদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে দেশবাসী সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নারী ও শিশু অধিকার ফোরামের সদস্যসচিব ও বিএনপি নেত্রী অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি পরিবারের মধ্যে আর্থিক অনুদান প্রদান এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় এ নেত্রী। নিপুণ রায় বলেন, আমরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আপনাদের সমবেদনা জানাতে এসেছি। আমরা আশ্বাস দিচ্ছি, বিএনপি আপনাদের সুখে-দুঃখে পাশে আছে ও থাকবে।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন গার্মেন্টশ্রমিক মামুন : মসজিদে বিস্ফোরণে দগ্ধ হওয়া মামুনকে (৩০) গত সোমবার বিকেলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসকদের পরামর্শে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। মামুন জানান, তিনি একজন গার্মেন্টশ্রমিক। বিস্ফোরণের সময়ে তিনি গলির ভেতর ছিলেন।
মসজিদের সিঁড়ির নিচে গ্যাসের পাইপলাইনের সন্ধান : নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার পশ্চিম তল্লা এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় মসজিদের সিঁড়ির নিচে গ্যাসের পাইলাইনের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এই পাইপে লিকেজ আছে কি না বলতে পারেননি খোঁড়াখুঁড়ির সাথে যুক্ত শ্রমিক ও তিতাসের কর্মকর্তারা। গতকাল বিকেলে ৮ ফুট মাটি খুঁড়ে তিন ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ পাওয়া যায়। তিতাসের নিয়োজিত শ্রমিকেরা জানান, মসজিদের দু’টি সিঁড়ি ভাঙতে হয়েছে। তারপর মাটি খুঁড়ে সিঁড়ির নিচেই পাওয়া গেছে লাইনটি। সম্পূর্ণ পাইপটি বের না করা পর্যন্ত লিকেজ আছে কি না বলা যাচ্ছে না।
এর আগে সোমবার সকাল ৯টা থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় মাটির নিচে গ্যাসের সম্ভাব্য উৎস অনুসন্ধানে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের তদন্ত কমিটি। মসজিদের বিভিন্ন দিকে ছয়টি গর্ত করে ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসের পাইপলাইন পাওয়া যায়।
তিতাসের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ঢাকা অফিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্ল্যানিং) আবদুল ওয়াহাব তালুকদার বলেন, ‘যে পাইপটির সন্ধান পাওয়া যায় তাতে দু’টি লিকেজ দেখা গেছে।’ তিতাসের নারায়ণগঞ্জের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো: মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘মসজিদের সিঁড়ির নিচে পাইপলাইন পাওয়া গেছে। লিকেজ আছে কি না সম্পূর্ণ কাজ শেষ হওয়ার পর জানানো হবে।’
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ : এ দিকে মসজিদের বিস্ফোরণের ঘটনায় পরদিন অবহেলা ও গাফিলতির অভিযোগে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেছে পুলিশ। এই মামলার তদন্তে এলাকাবাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। প্রথম দিন মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুরসহ বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গণমাধ্যমকে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) মেহেদী ইমরান সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে মসজিদটি নির্মাণের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়া হয়নি। এতে মসজিদ কমিটির দায় এখানে আছে। তাদের বিরুদ্ধে অবহেলার প্রমাণ পেলে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’ মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ করছি। কারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এ ঘটনায় যারা প্রকৃতভাবে অবহেলা করেছে তাদেরকে আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।’