আবু সাঈদের দেখানো পথেই শহীদ হন মিলন
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৯
দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াকু বীর মোসলেম উদ্দীন মিলন। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই নাম। শাহাদতের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ইতিহাসের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। ফ্যাসিবাদের কালোথাবা থেকে আপামর জনতার ন্যায্য অধিকার আদায়ে নিজের জীবন দিয়ে তিনি এ অধিকার বাস্তবায়ন করে গেছেন। যুগ যুগ ধরে তাকে মানুষ স্মরণ করবে একজন বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে।
১৯৮৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রংপুর জেলার কোতোয়ালি থানার পূর্ব গনেশপুর গ্রামে এই তেজস্বী বীর জন্মগ্রহণ করেন। ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ, মধ্যবিত্ত পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। পরিবারের সহায়তায় দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ পান তিনি। বাল্যকাল থেকেই ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। অল্প বয়সে তিনি বাবার মতো স্বর্ণকারের পেশায় নিজেকে যুক্ত করেন। সেই সাথে পরিবারের হালও ধরেন তিনি। নগরীর দেওয়ানবাড়ী সড়কের একটি জুয়েলার্সে কর্মরত ছিলেন।
ছাত্রসমাজের সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাপ্রথার সংস্কারের ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে শুরু থেকেই সমর্থন করতেন মোসলেম উদ্দিন। আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করার পেছনে তার আবেগী মন সব সময় কাজ করতো। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তার নিজ জেলা রংপুরের ছেলে নিরস্ত্র আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। যা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। বাসায় বারবার তার সেই ভিডিও দেখতেন আর বলতেন ‘কী অপরাধ ছিল ছেলেটির। আমাদের উচিত এর প্রতিবাদ করা।’ এরপর তিনি ভেবেছিলেন এতগুলো তাজা প্রাণের ঝরে যাওয়া দেখে সরকারের বোধোদয় হবে, তারা ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে কোটাপ্রথার সংস্কার করবে। কিন্তু সরকার ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে আদালতের রায় পরিবর্তনের কথা মুখে বললেও সরকারি পুলিশ বাহিনী একদিনের জন্যও গুলি করা থামায়নি। ফলে শহীদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ১৬, ১৭ ও ১৮ জুলাই এই তিন দিনে শহীদের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় শতকের ঘর। তাই সেদিন আর তিনি নিজেকে ঘরে বেঁধে রাখতে পারেননি।
দিনটি ছিল ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার। সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। জুমার নামাজের পর সারা দেশের ছাত্র-জনতা নেমে আসে রাজপথে। রংপুরও এর ব্যতিক্রম ছিল না। শহীদ মোসলেম উদ্দীন মিলন এ দিন জুমার নামাজ আদায় করে দুপুরের খাবার শেষে বেরিয়ে পড়েন। তখন সময় আনুমানিক বিকেল ৪টা। তিনি সাধারণ জনতার সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেন।
মিছিল এগিয়ে গেলে একপর্যায়ে পুলিশ ও সাধারণ জনতার মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। পুলিশ অন্যায়ভাবে সাধারণ জনতার ওপর টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও গুলি ছুড়তে শুরু করে। নিরস্ত্র জনতা দিগি¦দিক ছুটতে থাকে। আকস্মিক ঘাতক পুলিশের একটি বুলেট সরাসরি মোসলেম উদ্দিন মিলনের বুকে বিদ্ধ হয়। সে সময় তিনি মুড়িপট্টি, পৌরবাজারের সামনের রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে তিনি সেখানেই শাহাদত বরণ করেন। পরবর্তীতে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল থেকে আনুমানিক রাত ৮টায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। পরদিন শনিবার বেলা ৩টায় মুন্সিপাড়া কবরস্থানে নামাজে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
গত ২৭ আগস্ট নিহতের সহধর্মিণী দিলরুবা আক্তার বাদি হয়ে রংপুর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন।
শহীদ মোসলেম উদ্দীন মিলনের ছিল চার সদস্যের পরিবার। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে খুব সুন্দর ভাবেই দিনাতিপাত করছিলেন। তার একমাত্র আয়ের উৎস ছিল স্বর্ণের দোকানের ম্যানেজারি। সেখান থেকে তিনি পরিবারের ব্যয়ভার নির্বাহ করতেন। বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র আর ছোট ছেলে হিফজ মাদরাসায় পড়ে। মোসলেম উদ্দীন শহীদ হওয়ায় তার পরিবার পড়েছে আর্থিক সঙ্কটে। বর্তমানে ছেলের লেখাপড়ার খরচ ও পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। নিজের বসতভিটায় একটি পাকা ঘর নির্মাণের কাজও শুরু করেছিলেন মোসলেম উদ্দিন। এজন্য কিছু ঋণও করেন। ঘরটি সম্পূর্ণ করা হয়নি। কাজ চলমান রেখেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান তিনি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা