বড় পরিসরেই সংস্কার সম্ভব
একান্ত সাক্ষাৎকারে আলী রীয়াজ- বাসস
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৩১
জাতীয় ঐক্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয়ায় এ বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি ঢাকায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি আশাবাদী যে বড় পরিসরে এটি (সংস্কার) করা সম্ভব। এটি অসম্ভব নয় এবং আমি আরো আশাবাদী কারণ রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রীয়াজ বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের আশাবাদী হওয়া উচিত’, যদিও অনেকেই এ বিষয়ে ‘খুবই হতাশাবাদী’ এবং কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘যতটুকু প্রয়োজন তার এক দিনও বেশি ক্ষমতায় থাকতে চায় না।’
জাতীয় ঐক্য কমিশনের কর্মপরিকল্পনা
আলী রীয়াজ বলেন, কমিশনের প্রথম কাজ হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সরবরাহ করা, যা ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এই প্রক্রিয়ায় তাড়াহুড়ো করতে চাই না, কারণ ফলপ্রসূ আলোচনা নিশ্চিত করতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এটিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেখানে সংলাপ ও পদক্ষেপ একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।
তবে তিনি মনে করিয়ে দেন যে, ঐক্য কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে সংস্কার ইস্যুগুলোর ওপর ঐকমত্যে পৌঁছানোর কাজ শেষ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিক্রিয়া জানানো জরুরি এবং জনগণ নির্বাচনের জন্য উদগ্রীব থাকায় প্রক্রিয়াটি দ্রুততর করার প্রচেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ছয়টি কমিশন তাদের সুপারিশ প্রদান করেছে, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব বিকল্প প্রস্তাবও থাকতে পারে, যা তাদের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ শেষ পর্যন্ত, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই শাসনভার থাকবে।
রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জাতীয় স্বার্থের সাথে তাদের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
জাতীয় সনদ : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রীয়াজ বলেন, গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর প্রক্রিয়াটি একটি জাতীয় সনদে পরিণত হবে, যা ভবিষ্যতের যেকোনো সরকারের জন্য একটি নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেন, জাতীয় সনদ হবে পথনির্দেশক। যেই ক্ষমতায় আসুক, জনগণ জানবে যে এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে।
কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করবে যে- কোন সংস্কারগুলো নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করা হবে, কোনগুলো নতুন সংসদে তোলা হবে এবং কোনগুলো গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইচ্ছামত সংস্কারগুলো নির্ধারণ করবে এবং তাদের সুপারিশগুলো সুনির্দিষ্ট একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো কী ধরনের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। জনগণের সম্পৃক্ততা একটি অগ্রাধিকার হিসেবে রয়ে গেছে। যদিও জনসাধারণের সরাসরি মতামতের জন্য প্রক্রিয়া এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি
রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবে কি না- এ বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রীয়াজ বলেন, তিনি আশা করেন দলগুলো ভবিষ্যতের দিকে নজর রাখবে।
তিনি বলেন, আসুন আমরা অতীতের মতো বন্দী হয়ে না থাকি। অতীতে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ঐকমত্যের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তবে সফল চুক্তির দৃষ্টান্তও রয়েছে, যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।
তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে ১,৪০০-এর বেশি প্রাণহানি ঘটার পর রাজনৈতিক দলগুলো এখন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করছে।
রীয়াজ বলেন, কোনো দলই বলছে না যে সবকিছু ঠিক আছে। সবাই স্বীকার করছে যে শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্রতিটি দল সংস্কার চাইলেও তাদের অগ্রাধিকার আলাদা হতে পারে। আমাদের কাজ হলো আলোচনা সহজতর করে সাধারণ ভিত্তি খুঁজে বের করা।
নির্বাচনের পর সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ভাগ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে রীয়াজ পরামর্শ দেন যে, রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো একটি বাধ্যতামূলক জাতীয় সনদ প্রতিষ্ঠা করা, যা সমস্ত দল নির্বাচনের আগে ও পরে মেনে চলবে।
রীয়াজ বলেন, ‘এটি আদর্শ রূপরেখা।’ তবে এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করে তারা কিভাবে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করবে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ : রীয়াজ বলেন, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনতেই হবে।
তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘ আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের নথি সংরক্ষণ করেছে। রীয়াজ বলেন, এই গণহত্যার দায় একজন ব্যক্তির। এটি আমাদের কমিশনের আলোচনার বিষয় নয় বরং এটি একটি বিচারিক প্রক্রিয়া যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মোকাবেলা করতে হবে।
তিনি বলেন, এটি একই রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগ) যা ব্যক্তিবাদী স্বৈরাচারের জন্ম দিয়েছে। তাই তাদের আদর্শে অবশ্যই কিছু ভুল রয়েছে। এটি কেবল একটি ঘটনা হতে পারে না। এটি একবার ঘটেনি বরং দুইবার ঘটেছে (১৯৭২-৭৫ ও ২০০৯-২০২৪)।
তিনি বলেন, উভয় ক্ষেত্রেই এটি ‘সতর্কতার সাথে করা হয়েছিল। এটি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল, যা ওই রাজনৈতিক দলের আদর্শ এবং আমরা তা ভুলে যেতে পারি না।’
সংবিধান সংস্কার : সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান রীয়াজ বলেন, তাদের সুপারিশগুলো নির্বাহী আদেশে চাপিয়ে দেয়া যাবে না, বরং এটি জাতীয় ঐকমত্য এবং সুস্পষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে হবে।
তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কারে বিভিন্ন পথ রয়েছে- সংবিধান সভা, গণভোট বা সমঝোতার মাধ্যমে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে বা নিজস্ব পথ তৈরি করতে পারে।
রীয়াজ জোর দিয়ে বলেন, কমিশনের ভূমিকা ছিল সংবিধান পর্যালোচনা করা, ফাঁকগুলো চিহিৃত করা এবং সুপারিশ করা- সংস্কার প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করা নয়।
তিনি বলেন, আমরা কখনো ‘সংশোধন’ শব্দটি ব্যবহার করিনি। এ ক্ষেত্রে আমরা সংস্কারের প্রয়োজনীয় ধারাগুলো তুলে ধরেছি। কী গ্রহণ করবে এবং কিভাবে বাস্তবায়ন করবে তা সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বর্তাবে। তিনি উল্লেখ করেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনসহ কিছু প্রস্তাবের জন্য ব্যাপক রাজনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্ধারণ করতে হবে কোন পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন, তারপর বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
তিনি উপসংহার টেনে বলেন, আসুন প্রথমে নির্ধারণ করি কী পরিবর্তন প্রয়োজন। তারপর বাস্তবায়নের কথা ভাববো। আগে জাতীয় সনদটি তৈরি করা হোক।