১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ শাবান ১৪৪৬
`

ফেডারেল কাঠামোতে জনপ্রশাসনের পুনর্বিন্যাস চায় সংস্কার কমিশন

-

 মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্কোচন
নিকাহ রেজিস্ট্রাররা যাবেন ডিসির অধীনে
জেলা পরিষদ থাকবে না

জনপ্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত পুনর্গঠনে ব্যাপক পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। ফেডারেল কাঠামোতে জনপ্রশাসনের পুনর্বিন্যাস চায় কমিশন। এই বিন্যাসে কমিশন বাংলাদেশের বিদ্যমান জনপ্রশাসনের কাঠামোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করার কথা বলেছে। এ বিন্যাসে একদিকে চারটি প্রদেশ ও একটি রাজধানী সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। অন্য দিকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কমিয়ে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের কাঠামো পুনর্বিন্যাস প্রসঙ্গে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ৫৩ বছরে সরকারের মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ১৫ থেকে ৩৬-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় অযৌক্তিকভাবে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। একই বিষয়ে একাধিক মন্ত্রণালয় কাজ করে থাকে। ফলে একদিকে সরকারের ব্যয় বেড়েছে, অপর দিকে জনপ্রশাসনের কাজের মাত্রা ও দক্ষতা কমেছে।
সংস্কার কমিশন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন সংস্কারের সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ৬ মাসের স্বল্প মেয়াদে বর্তমানে মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৬১টি বিভাগকে কমিয়ে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ করছে। স্বল্প মেয়াদেই মন্ত্রণালয়গুলোকে পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত করার কথা বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয়/বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও মাঠ পর্যায়ের দফতরগুলোর সাংগঠনিক ও জনবল কাঠামো সংস্কার বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে মধ্য মেয়াদে।
কমিশনের মতে, যদি একই বা কাছাকাছি কাজের ধরন অনুযায়ী মন্ত্রণালয়গুলোকে কয়েকটি গুচ্ছে ভাগ করা হয় এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সার্ভিস ও বিষয়ের কর্মকর্তাদের পোস্টিং দেয়া হয় তাহলে তাদের পক্ষে ক্যারিয়ার প্লানিং করে বিশেষজ্ঞ হওয়া সহজতর হবে। কোনো কর্মকর্তা সচিবালয়ে পোস্টিং পাওয়ার আগে যে ক্লাস্টারে অপশন দিবেন তাকে পরবর্তী চাকরি জীবনে সে ক্লাস্টারেই থাকতে হবে।
মন্ত্রণালয়গুলোকে ৫টি গুচ্ছে ভাগ করার প্রস্তাব করেছে কমিশন। এর মধ্যে বিধিবদ্ধ প্রশাসন বিভাগে যেসব মন্ত্রণালয়/বিভাগ আইন প্রয়োগকারী, জনপ্রশাসন এবং নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে কার্যাবলী তত্ত্বাবধান করে সেগুলো এ গুচ্ছের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য গুচ্ছে রাখা হয়েছে, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, শিল্প ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কিত বিষয় ফোকাস করে এরূপ মন্ত্রণালয়গুলোকে। এ ক্লাস্টারের লক্ষ্য হচ্ছে সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালনা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখা।
মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন ক্লাস্টারে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর দায়িত্ব পালনরত মন্ত্রণালয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হবে। এ ক্লাস্টারের লক্ষ্য নাগরিক জীবনযাত্রার মান সামাজিক মঙ্গলজনক কার্যক্রম উন্নত করা। ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ শীর্ষক গুচ্ছে সড়ক, সেতু, রেলপথ এবং আবাসনের মতো ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের সাথে জড়িত মন্ত্রণালয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হবে। এ ক্লাস্টারের লক্ষ্য সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করা। কৃষি, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও পরিবেশ ক্লাস্টারে টেকসই কৃষি ও আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করবে। এ ক্লাস্টারের লক্ষ্য পরিবেশগত স্থায়িত্বের সাথে মিল রেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখা।
বলা হয়েছে, স্বল্প মেয়াদে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে একই কর্মকর্তাকে দ্বৈত দায়িত্ব থেকে আলাদা করে একজন সচিবের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ রাজস্ব নীতি প্রণয়ন করবে। আর নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য তিনটি দফতর থাকবে। নবগঠিত তিনটি অধিদফতরের জন্য আলাদা আলাদা মহাপচিালক পদ সৃজন করে জনবল পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পুনর্গঠন করে ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান কমিশন’ হিসেবে রূপান্তরের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে যাতে এটি একটি স্বাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার জন্য আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে। স্বল্প মেয়াদেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষ (বেপজা), অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষ, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতো একই ধরনের দায়িত্ব পালন করে বিধায় এ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাথে একীভূতের সুপারিশ করা হয়েছে।
স্বল্প মেয়াদেই ‘জেলা প্রশাসক’ ও ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার’ পদবি পরিবর্তন করে ‘উপজেলা কমিশনার’ ও ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার’ করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। ‘অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)’ পদবি পরিবর্তন করে ‘অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি ব্যবস্থাপনা) করার কথা বলা হয়েছে।
জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্বল্প মেয়াদি ৯০ হিসেবে সিআর মামলা প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিস বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা নেয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন। পরে মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে চলে যাবে।
থানার ‘অফিসার-ইন চার্জ’ এর কাজ ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার তদারকির জন্য উপজেলা পর্যায়ে একজন সহকারী পুলিশ সুপারকে ‘উপজেলা জননিরাপত্তা অফিসার’ হিসেবে পদায়নের সুপারিশ করে বলা হয়েছে। এর ফলে থানার জবাবদিহিতা আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়।
বিবাহ রেজিস্ট্রিকরণ কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করে এর নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকের অধীনে ন্যস্তর সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। বলা হয়েছে, বিবাহ রেজিস্ট্রি মুসলিম সমাজের একটি নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। বর্তমানে নিকাহ রেজিস্ট্রাররা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক লাইসেন্স পেয়ে থাকেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসকের অধীনে ন্যস্তকরা হলে কাজটি অনেক সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে আপিলের কোনো বিষয় থাকলে তা বিভাগীয় কমিশনার পর্যায়ে নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা থাকতে পারে।
প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দেশের জনসংখ্যা বাড়াক এবং সরকারের কার্যপরিধি সুবিস্তৃত হওয়ার ফলে বর্তমান প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার কাঠামো যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয় না। অপর দিকে, এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় মন্ত্রণালয় পর্যায়ে খুঁটিনাটি বহু কাজ সম্পাদন করা হয়। ক্ষমতার প্রত্যর্পণ (ডেলিগেশন) বিবেচনায় দেশে বিশাল জনসংখ্যার পরিষেবা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে দেশের পুরনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এর ফলে এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ কমবে। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমবে।
রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনায় রেখে নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ বা ‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। অন্যান্য প্রদেশের মতোই এখানেও নির্বাচিত আইন সভা ও স্থানীয় সরকার থাকবে। ঢাকা মহানগরী, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’এর আয়তন নির্ধারণ করা যেতে পারে।
এর বাইরে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও ১০টি প্রশাসনিক বিভাগ গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। বিভিন্ন সময়ে জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশে মোট ৮টি প্রশাসনিক বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ গঠনের দাবি অনেক দিনের। ভৌগোলিক ও যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনায় কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দু’টি নতুন বিভাগ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস একই কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আনার সুপারিশ করে বলেছে, বর্তমানে জমি ক্রয়-বিক্রয় রেজিস্ট্রি করার ক্ষেত্রে উপজেলা ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মধ্যে সমন্বয় সাধন সঠিকভাবে হয় না। সাম্প্রতিককালে ভূমি অফিসে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হলেও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এখন পর্যন্ত ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আসেনি। সাব-রেজিস্ট্রি অফিস বর্তমানে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে। এ দফতরটি দ্রুত ভূমি অফিসের নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করা উচিত।


আরো সংবাদ



premium cement
মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তন করে ‘আমেরিকা উপসাগর’ করল গুগল যশোরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বিএনপি নেতাদের ওপর আ’লীগের হামলা ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি স্ত্রীসহ সাবেক ওসি মাজহারুলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক গভর্নরকে ট্রাম্পের ক্ষমা সিরাজদিখানে নিখোঁজের ১১ দিন পর লাশ উদ্ধার, আটক ৪ কোনো অন্যায়ের কাছে যুবক তরুণেরা মাথা নত করবে না : ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ডিসেম্বরকে ধরে নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি পাবনায় ট্রলির ধাক্কায় সিএনজির ২ যাত্রী নিহত সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠন করা হবে : আসিফ মাহমুদ লক্ষ্মীপুরে আগুনে ২০ দোকান পুড়ে ছাই

সকল