১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৬
`

‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিলে ১৮ কোটি মানুষ ক্রীতদাসে পরিণত হয়’

আপিল বিভাগে রিভিউ শুনানি আজ
-


বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে আনা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদনের (রিভিউ) ওপর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও বিশিষ্টজনদের করা তিনটি আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা আজ। আপিল বিভাগের ১৯ জানুয়ারির কার্যতালিকায় ১৩ নম্বরে এই রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য রয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আপিল বিভাগ ওপেন কোর্টে ২০১১ সালের ১০ মে যে রায় দিয়েছিলেন, তাতে পরবর্তী দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে উল্লেখ ছিল; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ওই রায় বলবৎ থাকাকালীন আপিল বিভাগের রায় অমান্য করে ২০১১ সালের ৩০ আগস্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে, যা সংবিধানের আর্টিকেল-১১১ পরিপন্থী। পরবর্তী সময়ে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০১১ সালের ১৭ মে অবসর গ্রহণের ১৬ মাস পরে সর্বোচ্চ আদালতের প্রকাশ্য রায়ের অংশ পরিবর্তন করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। মূল রায়দাতা বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত আদেশ বদলে ফেলার অভিযোগ খোদ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকেই উত্থাপিত হয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা জানান।
তখন দেশবরেণ্য প্রবীণ তিনজন আইনজীবী মরহুম বিচারপতি টি এইচ খান, মরহুম ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ড. কামাল হোসেন এ ঘটনাকে বিচারিক অসদাচরণ ও বিচ্যুতি বলে অভিহিত করেছিলেন।

এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক একজন বিচারপতি গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এই ব্যক্তির (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) কারণে দেশের ১৮ কোটি মানুষ ১৬ বছর ক্রীতদাসের মতো জীবন যাপন করেছে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তার মনিব শেখ হাসিনার ইঙ্গিত বা নির্দেশ ছাড়া কোনো রায় বিচারপতি হিসেবে দেননি।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিলে সরকারের প্রভাব ছিল। বর্তমানে আদালতের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ নেই, আদালত স্বাধীন সে জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করেন হাইকোর্ট।
গত ১৬ অক্টোবর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করেন। এ ছাড়া ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আবেদনে ১০টি যুক্তি উত্থাপন করা হয়েছে। রিভিউ আবেদনে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ ধ্বংস করা হয়েছে। এই বিধান বাতিলের পর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে নজিরবিহীন কারচুপির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। ফলে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতির কাঁধে ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসে।
জয়নুল আবেদীন বলেন, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সংশোধন করে তৎকালীন আওয়ামী সরকার। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংসদে বাতিল করা হয়। পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। আদালতে ঘোষিত রায়ের সাথে প্রকাশিত রায় ভিন্ন ছিল, যা বিচার বিভাগীয় প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।

এর আগে গত ২৫ আগস্ট পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিকও রিভিউ চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তারা হলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান।
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ১৯৯৬ সালে। এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগ এ রিট খারিজ করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল