শিক্ষার্থীদের বই বিতরণে আ’লীগের প্রতারণা
- শাহেদ মতিউর রহমান
- ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের বই উৎসবের নামে আনন্দে মাতিয়ে সব সময় প্রতারণা করেছে আওয়ামী লীগ। বিনা মূল্যের বই বিতরণে শতভাগ সফলতার গল্প-কাহিনী শোনালেও আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি শাসনামলের তথ্য-উপাত্ত বলছে ভিন্ন কথা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের পর থেকেই আওয়ামী লীগের দীর্ঘ এ সময়ে কখনোই তারা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দিতে পারেনি। এমনকি কোনো কোনো বছর শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পেঁৗছে দিতে বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানিয়েছে, বছরের প্রথম দিনে বই উৎসব ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের একটি প্রতারণা মাত্র। তারা ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের উৎসবের আনন্দে মাতিয়ে মূলত অর্থ লুটপাট আর টাকা ভাগাভাগিতে ব্যস্ত ছিল। বিভিন্ন মিডিয়াতে ফলাও করে বই উৎসবের সংবাদ ও ছবি প্রচার করে কোটি কোটি শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে সরিয়ে রাখার কৌশল ছিল আওয়ামী লীগের। কেননা বছরের প্রথম দিনে অর্ধেক শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেয়া সম্ভব না হলেও বিগত বছরগুলোতে বই উৎসবকে একটি সার্বজনীন উৎসবের আমেজ দেয়ার কৌশল নিয়েছিল তারা। কিন্তু নয়া দিগন্তের হাতে আসা পরিসংখ্যান বলছে ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কোনো বছরই আওয়ামী লীগ সরকার বছরের প্রথম দিনে ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারেনি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেয়ার যে পরিসংখ্যান সেখানে শতভাগ বই পেতে শিক্ষার্থীদের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। সূত্রমতে, ২০১০ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই দেয়া শুরু হয়। সে বছর এনসিটিবি থেকেই বই প্রকাশে ইচ্ছাকৃতভাবে সময় ক্ষেপণ করা হয়। অর্থাৎ ২০০৯ সালে শিক্ষার্থীরা সব সংগ্রহ করতে তাদেরকে সেপ্টেম্বর মাসের ২৬ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এরপর ২০১০ সালে শিক্ষার্থীরা সব বই হাতে পায় ২১ জুলাই তারিখে। এভাবে পর্যায়ক্রমে কোনো বছরই শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবর্ষের অর্ধেক সময় চলে যাওয়ার পরেই শতভাগ বই পেয়েছে। ঠিক এভাবেই ২০১৬ সালে শিক্ষার্থীরা সব বই হাতে পায় মার্চ মাসের ২২ তারিখ। ২০১৭ সালে বই পায় ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ। ২০১৮ সালে বই পায় মার্চের ১৩ তারিখ। ২০১৯ সালে বই পায় এপ্রিলের ২৭ তারিখ। ২০২২ সালে বই পায় মার্চের ২৪ তারিখ। ২০২৩ সালে বই পায় মার্চের ১৭ তারিখ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীরা সব বই হাতে পায় মার্চের ৭ তারিখে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিগত দিনে আওয়ামী লীগ বই উৎসবের নামে যেভাবে অর্থ লুটপাট করেছে তা নজিরবিহীন। পহেলা জানুয়ারিতে ঢাকায় বই উৎসবের নামে একটি হল ভাড়া বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬২ টাকা। আবার হল রুমের ইন্টারনেট কানেকশনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এভাবে নানা খাত-উপখাতে গত চার বছরে চারটি বই উৎসবের নামে সরকারি বিভিন্ন দফতর থেকে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯৩ লাখ ২১ হাজার তিন টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন আওয়ামী লীগের বই উৎসব ছিল মূলত শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেয়ার নামে অর্থ লুটপাটের আয়োজন করা। কেননা বই উৎসব করে শিক্ষার্থীদের বই দেয়া হলেতো কোনো শিক্ষার্থী উৎসবের দিনে বই না পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু আদতে হয়েছে তার উল্টো। বই পেতে শিক্ষার্থীদের বছরের অর্ধেক সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বই উৎসব তখনি হতে পারে যখন সব শিক্ষার্থী একসাথে সব বই হাতে পাবে। কিন্তু বিগত দিনে মূলত শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। শতভাগ বই দিতে না পারলে সেখানে আবার কীসের উৎসব? তিনি আরো বলেন, ২০২৫ সালে আমরা উৎসবের কোনো আয়োজন করিনি। গত ৫ আগস্টের পর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভিন্ন। পাঠ্যবইয়ে এবার অনেক কিছুই পরিবর্তন/পরিমার্জন করতে হয়েছে। আগের কারিকুলামও বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে বেশকিছু কন্টেন্ট পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া আগের বছরগুলোতে যখন বই ছাপা শুরু হতো এ বছর সেই সময়ে বইয়ের পরিমার্জনের কাজ করতে হয়েছে। এরপর অনেকগুলো ধাপ পার হয়েই পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ শুরু করা হয়েছে। এরপরেও এবার সবাইকে এবং সব বই একসাথে দেয়া সম্ভব না হলেও প্রাথমিকের বেশিরভাগ বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে। মাধ্যমিকের বইয়ের ছাপার কাজও পুরোদমে চলছে। আশা করছি বিগত বছরের তুলনায় এবার আগেই সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই পৌঁছে দেয়া যাবে। একইসাথে এবারের বই হবে মানের বিবেচনায় অনেক উন্নত ও টেকসই।