কামরুল, মহিববুর, হেনরী ও এস কে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের ৮ মামলা
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪৭
অবৈধ সম্পদ ও অর্থপাচারের অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, মহিববুর রহমান, সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী ওরফে এস কে সুর চৌধুরী ও তাদের স্ত্রী-সন্তানের বিরুদ্ধে আটটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গতকাল দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকায় চার কর্মকর্তা পৃথকভাবে মামলাগুলো দায়ের করেন। দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো: আক্তার হোসেন প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন।
মামলায় সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ, সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মো: মহিববুর রহমানের বিরুদ্ধে ১১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও ৩৯ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগ, সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে ৪৯ ব্যাংক হিসাবে প্রায় তিন হাজার ৮৯৩ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী ওরফে এস কে সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
কামরুলের সাড়ে ৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ
প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ঢাকা-২ আসনের সাবেক এমপি ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়। এ ছাড়া দুদকের অনুসন্ধান টিম কামরুল ইসলামের স্ত্রী বেগম তায়েবা ইসলাম, ছেলে ডা: তানজীর ইসলাম ও মেয়ে সেগুপ্তা ইসলামের সন্দেহজনক সম্পদের তথ্য পাওয়ায় তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে বলা হয়েছে।
দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কামরুল ইসলামের স্ত্রী তায়েবা ইসলামের সন্দেহজনক সম্পদ থাকতে পারে। ছেলে ডা: তানজীর ইসলামের এক কোটি ৪৬ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৫ টাকা এবং মেয়ে সেগুপ্তা ইসলামের এক কোটি ১০ লাখ ৪৮ হাজার ৯২৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তাদের নামে ও বেনামে আরো সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, আসামি কামরুলের নামে ছয় কোটি ২৯ লাখ ১৯ হাজার ১৯৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া যায়, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন সম্পদ অর্জন করেছেন, যার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
এছাড়া মো: কামরুল ইসলাম নিজ এবং তার প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে পরিচালিত ১৫টি হিসাবে মোট ২১ কোটি ১৮ লাখ ১৫ হাজার ৪৬৫ টাকা লেনদেন করেন।
গত ১৮ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরা-১২ নম্বর সেক্টর থেকে কামরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গত ১৪ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক।
২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে সবগুলো জাতীয় নির্বাচনে জয় পান আওয়ামী লীগের এই নেতা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ প্রতিমন্ত্রী ও ২০১৪ সালে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ের পর তার বিরুদ্ধে নিয়োগ, বদলি ও খাদ্য আমদানিসহ বিভিন্ন কাজে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০১৫ সালের জুনে ব্রাজিল থেকে ৪০০ কোটি টাকা মূল্যের দুই লাখ টন পচা গম আমদানির ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন কামরুল।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহিববুর ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ২ মামলা
১১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও ৩৯ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো: মহিববুর রহমান এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি মামলা করেছে দুদক। সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম বাদি হয়ে মামলাটি করেন।
প্রথম মামলায় সাবেক মন্ত্রী মো: মহিববুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব আমলে নেয়া হয়েছে। যেখানে সাত কোটি ৬৪ লাখ ৩১ হাজার ৪৭৯ টাকার সম্পদের জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন ও ২৩ ব্যাংক হিসাবে ২৩ কোটি ৭২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৭৬ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় মামলায় তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ তিন কোটি ৯২ লাখ ১৯ হাজার ৭৫২ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জনপূর্বক তা দখলে রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে। যার সপক্ষে বৈধ মালিকানা পাওয়া যায়নি দুদকের অনুসন্ধানে। এ ছাড়া তার নামে থাকা ১১টি ব্যাংক হিসাবে ১৫ কোটি ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৮ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
হেনরী ও স্বামীর পৌনে ৪ হাজার কোটি টাকা লেনদেন
সিরাজগঞ্জ-২ আসনের আলোচিত সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী শামীম তালুকদারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুদক। সোমবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এ মামলা করেন সহকারী পরিচালক আসিফ আল মাহমুদ।
মামলায় জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী শামীম তালুকদারের ৪৯ ব্যাংক হিসাবে প্রায় তিন হাজার ৮৯৩ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই সাথে প্রায় ৭৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনেরও প্রমাণ মিলেছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
দুদক মহাপরিচালক মো: আক্তার হোসেন জানান, সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরীর ৫৭ কোটি ১৩ লাখ সাত হাজার ২২৩ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করে ভোগ দখলে রেখেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এছাড়াও ৩৫টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে দুই হাজার দুই কোটি ৬৬ হাজার ৫৭৭ টাকা এবং ১৩ কোটি ৭৮ লাখ মার্কিন ডলারের সন্দেহজনক লেনদেন করেন। এর মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে পাওয়া অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে রূপান্তর, হস্তান্তর ও স্থানান্তর করে দুদক আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। অন্যদিকে, তার স্বামী শামীম তালুকদারের ব্যাংক হিসাবে ৩৬০ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ নভেম্বর জান্নাত আরা হেনরী, তার স্বামী ও মেয়ের দেশত্যাগে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। হেনরীর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয় গত ২০ আগস্ট। গত ১ অক্টোবর মৌলভীবাজার থেকে স্বামীসহ গ্রেফতার হন তিনি।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক থাকার সময়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ার সুবাদে হেনরী অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এস কে সুরের বিরুদ্ধে মামলা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী ওরফে এস কে সুর চৌধুরী ও তার স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরী এবং কন্যা নন্দিতা সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুদক। সোমবার তাদের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য এস কে সুর চৌধুরীকে দুদক থেকে চিঠি দেয়া হয়। একাধিকবার তাগাদা দেয়া হলেও তারা সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেননি। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করায় তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইনে মামলা (নন-সাবমিশন) করা হয়েছে। উপপরিচালক নাজমুল হুসাইন এসব মামলা করেন।