২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
বৈষম্যবিরোধী-বীরত্বগাথা

সংসারের চাকা ঘুরাতে ঢাকায় গিয়ে লাশ হলেন শহীদ সিয়াম

-

দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান সিয়াম। পরিবারের হাল ধরার জন্য কাজ নেন রাজধানী ঢাকার মিরপুর বেনারসি পল্লী এলাকার রাব্বানী হোটেলে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকালে গত ১৮ জুলাই মিরপুরে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে ওই সময়ে শহীদ সিয়াম সরদারকে (১৭) কোন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা ছাড়াই দাফন করা হয় চাঁদপুর সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নের দক্ষিণ হামনকর্দী গ্রামে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পরিবারের সব স্বপ্ন এখন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
সিয়ামের সমবয়সী চাচাত ভাই মো. আতিক বলেন, ‘গত ১৮ জুলাই সিয়ামের মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগেও তার সাথে মোবাইল ফোনে কথা হয়। দেশের পরিস্থিতি ভালো নয় বলে আমি তাকে সতর্ক থাকার জন্য বলি। সে আমাকে জানায়, এখনো সে ভাত খায়নি। ভাত খেতে হোটেলে যাবে। পরে রাত ১১টার দিকে গ্রামের বাড়ি থেকে আমাকে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানানো হয়। খবর পেয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখি তার চোখে গুলি লেগেছে। সেখানে সে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। পরে হাসপাতাল থেকে তার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে নিয়ে আসি। তিনি আরো বলেন, পরে জানতে পারি ১৮ জুলাই সকালে হোটেলে কাজ শেষে দুপুরে সিয়াম লোকজনের সাথে ছাত্রদের আন্দোলনে যায়। পরে রাতের খাবারের জন্য বাসা থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হন। সেখান থেকে লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। জানা গেছে, সিয়াম সরদার তিন ভাই বোনের মধ্যে ছোট। বড় বোন জান্নাত আক্তার (২৪) ও ছোট বোন হাসি আক্তারের (১৯) বিয়ে হয়েছে। তারা স্বামীর বাড়িতে থাকে। ঢাকায় কাজে যাওয়ার আগে সিয়াম মা জেসমিন বেগম ও বাবা সোহাগ সরদারের সাথেই নিজ বাড়িতে থাকতেন। ছোট বেলায় একবছর স্থানীয় হামানকর্দী দারুল উলুম হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়েন। এরপর এলাকার হামানকর্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সংসারের অভাবের কারণে আর পড়তে পারেননি বলে পরিবারের সদস্যরা জানায়।
সিয়ামের বোন হাসি আক্তার বলেন, ‘তার সাথে মৃত্যুর আগের দিন রাতে আমার কথা হয়েছে। ওই সময় আমি তাকে বাড়িতে যাব বলে জানিয়েছি। সিয়ামও তাকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে।’ এরপর সিয়াম মোবাইল ফোনে বোনের মেয়ের সাথে কিছু সময় দুষ্টুমি করে ফোন কেটে দেয়। সিয়ামের দাদী লিলু বেগম (৬৫) বলেন, ‘আমার এক ছেলে। ছেলেরও একমাত্র নাতি সিয়াম। বাড়ির সবাই তাকে খুবই আদর করত। সিয়াম যখন বাড়িতে ছিল তাকে বলতাম-আমি যখন মারা যাব তুমি মাটি দিবা। কিন্তু আমার মৃত্যুর আগেই নাতি দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো। আমার নাতি সবার সাথে খুব ভালো আচরণ করতো। তার এই মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের আমি বিচার চাই।’

শহীদ সিয়ামের মা জেসমিন বেগম (৪২) বলেন, পড়াশুনা না করায় ছেলে আমার সংসারের হাল ধরতে কাজে যায়। ঢাকায় গিয়ে রাব্বানী হোটেলে ২১ দিন চাকরি করে। ২২ দিনের সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। তার সাথে সর্বশেষ আমার কথা হয় ১৬ জুলাই। ঢাকার পরিস্থিতি ভালো না, ছেলেকে সতর্ক থাকার জন্য বলি। সে কাজে আছে বলে আমার ফোন কেটে দেয়। এরপর আবার বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ফোন দেয়। কিন্তু আমি ফোনের কাছে না থাকায় কথা বলতে পারিনি।
তিনি আরো বলেন, দুই মেয়ের বিয়ের পরে ছেলেকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। তারা বাবা কৃষক। সংসারে তেমন আয় রোজগার নেই। ফলে স্বপ্ন ছিল, সেই সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু সেসব স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। ঢাকায় গিয়ে ছেলে আমার মৃত্যুর মুখে পড়বে, এমন জানলে তাকে আমি ঢাকায় পাঠাতাম না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আমাদের পুরো পরিবার এখন দিশেহারা। আমরা সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই। আর কী কারণে আমার ছেলেকে হত্যা করা হলো এবং যারা জড়িত তাদের বিচার চাই।
সিয়ামের বাবা সোহাগ সরদার (৪৬) জানান, আমার ছেলে হত্যার বিচারের জন্য আগস্ট মাসে ঢাকায় কয়েকটি থানায় মামলা করতে যাই। কিন্তু থানা মামলা না নেয়ায় মিরপুর এলাকার বিএনপি নেতা আমিনুল হকের সহযোগিতায় ঢাকা সিএমএম কোর্টে হত্যা মামলা দায়ের করি।
তিনি জানান, ছেলের মৃত্যুর পর রাব্বানী হোটেল কর্তৃপক্ষ ১ লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। বিএনপি নেতারা বাড়িতে এসে সমবেদনা জানিয়েছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা এবং কিছু ফল দিয়ে গেছে। এখন সরকারি সহায়তা ছাড়া আমরা কি করে সামনের জীবন পার করব বলেন। আমরা সবাই চাই সরকার আমাদের দিকে নজর দিক।


আরো সংবাদ



premium cement