পরিবর্তন আনতে না পারলে রক্তের সাথে বেঈমানি হবে
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:০১
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নয়, রাষ্ট্র সংস্কার করতে ছাত্ররা রক্ত দিয়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে। আমরা যদি পরিবর্তন করতে না পারি তাহলে এই রক্তের সাথে বেঈমানি করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই?’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
সেমিনারে ইসি সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ক্ষমতা আমাদের নেই। এটি করবে অন্তর্বর্তী সরকার। আমাদের এখতিয়ার হলো কতগুলো সংস্কারের সুপারিশ করা। রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি (আরএফইডি) আয়োজিত এ সেমিনারে দেশের রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আরএফইডির সভাপতি একরামুল হক সায়েম।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ছাত্ররা যে রক্ত দিয়েছে সেটি রাষ্ট্রের সংস্কার করার জন্য, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নয়। রাষ্ট্রের যে ব্যবস্থাপনা সেটি ভেঙে পড়েছে, অনেক জায়গায় মাটির সাথে মিশে গেছে। সেটিকে দাঁড় করানো চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি বলেন, সংস্কারের যে আলাপ হচ্ছে সেগুলো আমার বিশ্বাস রাজনৈতিক দলগুলোও ধারণ করবেন। তবে দু-একটি জায়গায় যেগুলো আমরা সবাই দেখেছি এগুলো শোধরাতে সময় লাগবে। আমি প্রত্যেককে ওতপ্রোতভাবে এর সাথে জড়িত থাকার আহ্বান জানাই। আসলে দেশ পরিচালনা রাজনীতিবিদরাই করবেন আজকে হোক. কালকে হোক। কাজেই দায়-দায়িত্ব তাদের আজ থেকেই শুরু করতে হবে।
উপদেষ্টা সাখাওয়াত বলেন, ডিসিরা নির্বাচন করেন এ কথা ঠিক নয়। আইনে ৩০০ আসনে ৩০০ রিটার্নিং অফিসার দেয়া যাবে। আবার ডিসিদের দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নির্বাচন কমিশনকে ভোটের সময় সরকারের ওপর কিছুটা খবরদারির এখতিয়ার দিতে হবে। তিন ধাপে ইসি নিয়োগ করা যেতে পারে। তৃতীয় ধাপে পার্লামেন্ট থেকে চূড়ান্ত প্রস্তাব যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। প্রথম ধাপে সবার নামই প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, দলের প্রার্থী হতে হলে দলের প্রাথমিক সদস্য পদে অন্তত তিন বছর থাকতে হবে। তৃণমূলে এক দুই বছর থেকে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এ ছাড়া নারী প্রার্থী ৫০ জন বা ১০০ জন, যাই করেন সেটি সরাসরি নির্বাচনে করেন। সংরক্ষিত আসনে নারীদের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না।
নির্বাচনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটার তালিকা থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য হতে হবে। পুরো প্রক্রিয়া সঠিক ও জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। তিনি বলেন, প্রস্তাব উত্থাপন, সুষ্ঠু, অঙ্গিকার নিরপেক্ষ, সততা, পেশাদারিত্বের সাথে প্রস্তাব দেব। যাতে এত প্রাণের রক্তের সাথে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করা না হয়। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আমাদের এখতিয়ার নয়, এটি সরকারের এখতিয়ার। মতামতের মাধ্যমে যেন সরকার সঠিক সিদ্বান্ত নেয়। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিকভাবে বাতিল করা হয়েছিল। এটি করা হয়েছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য। এ জন্য নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ সরকার দরকার, সে যেভাবে হোক। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী যেন নিরপেক্ষ আচরণ করে। এরপর হলো দল। দল যদি দায়িত্বশীল না হয়, তারা যদি ছলে বলে কৌশলে, টাকার খেলা করে, পেশিশক্তির ব্যবহার করে, গণমাধ্যম যদি সঠিক খবর না দেয় তাহলে সঠিক নির্বাচন ব্যাহত হয়। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন কল্পনাতেই থেকে যাবে।
বাংলাদেশে যে সঙ্কট রয়েছে, তা নির্বাচনকেন্দ্রিক সঙ্কট বলে মনে করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন। তিনি বলেন, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে উচ্চ আদালতের রেফারেন্সে এই সরকার গঠিত হয়েছে। যার ফলে এটি একটি সাংবিধানিক সরকার। তিনি বলেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি একেবারে যৌক্তিক নয়। বাস্তবতার নিরিখে যা সংস্কার করার দরকার তাই করা হবে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট হওয়া উচিত না। প্রয়োজনে আবার ভোট করতে হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারকে একাকার করলে যে দুরবস্থা হয়, সেটিই হয়েছে বাংলাদেশে। তিনি বলেন, ঐকমত্য শব্দটা আপেক্ষিক। সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি কিন্তু অভিভাবকের পরিচয় দিয়েছে। নির্বাচিত হলেও পরে অন্যান্য দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। আমাদের সমস্যা অনেক জায়গায়। তিনি বলেন, বর্তমান সংবিধানের সব জায়গায় কিছু কিছু নতুন জিনিস সংযুক্ত দরকার। তিনি বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল আছে তারা সব আসনে প্রার্থী দেয় না। সারা দেশ থেকে সব প্রার্থী এনে সেই আসনে জমা করে, এটাও একটা সূক্ষ্ম কৌশল।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সুষ্ঠু নির্বাচন করার আন্তরিকতার অভাব আছে। নির্বাচন সংস্কার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রস্তাব দেয়া। অংশীজনদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেই প্রস্তাব তৈরি করবে। সেই প্রস্তাব সরকার দেখবে তার পর আবারো অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বসা।
পাঁচজন ফেরেশতা এনে বসিয়ে দিলেও নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবে না বলে মনে করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নে আমরা রাজনৈতিক ঐকমত্যে আসতে পারিনি। দলগুলোর প্রতি একধরণের অনাস্থা এসেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই জায়গায় যায়নি যে, দলীয় সরকারের অধীনে তারা সুষ্ঠু ভোট করবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখাই জরুরি। সার্চ কমিটির ব্যাপারে দলগুলো একমত হতে পারেনি জানিয়ে তিনি বলেন, শুধু রাজনৈতিক দল নয় যত অংশীজন আছে সবার সাথে বসতে পারেন।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, প্রথমে ওনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) এসে বললেন অনেকগুলো সংস্কারকাজ করবেন। তিন মাস সময় দেয়া হলো। এই তিন মাস সময় লাগার তো কথা না। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সংবিধান সংস্কার করা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকার কেন অপেক্ষা করছে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ফিরিয়ে আনা। নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া ও প্রচলিত ব্যবস্থা পরিবর্তন করে আনুপাতিক ব্যবস্থা জরুরি।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, নির্বাচন কমিশন নিজেই একটা কমিশন, তার আবার সংস্কার কমিশন কেন প্রয়োজন। বদিউল আলমকে সরাসরি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে দিলে পারত। দু’জনের ব্যাপারে আপত্তি জেসমিন টুলী ও আব্দুল আলীমের। তবে এ তথ্যগুলো অসত্য। তিনি বলেন, আইনি যে কাঠামো আছে এগুলো ব্যবহার করে স্বচ্ছ নির্বাচন করা যায়। সংস্কারের চেয়ে কুসংস্কারের দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। প্রার্থীরা পছন্দের ডিসি এসপি নেয়ার জন্য তদবির করে। কেন্দ্রভিত্তিক দখলদারিত্ব ও ডামি প্রার্থী দেয়া এগুলো ইলেকশন রিগিংয়ের ছোট ছোট পয়েন্ট।
জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক ভোট চেয়েছি। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচনের জন্য দরকার সংবিধানে সংশোধন এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত আনা। নিবন্ধন প্রথা বাতিলের পাশাপাশি একাধিক দিনে নির্বাচন আয়োজন ডিজিটাল মেশিন ও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। সরকারি চাকরিজীবী চাকরি ছাড়ার তিন বছরের মধ্যে ভোট করতে পারবেন না। স্থানীয় সরকারের দলীয় প্রতীক প্রথা বাতিল করতে হবে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চুইংগামের মতো কাস্টিং বাড়িয়ে ভোট ৪০ শতাংশ দেখানো হয়েছে। তিনি বলেন, এমপিদের ১০ লাখ টাকা বেতন দিতে হবে। একটা ভোটে কত শতাংশ এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট হবে সেটি সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে আবার ভোট করতে হবে। সংবিধানে ৪৮ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক এই সংসদ সদস্য।
গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, জাতীয় পার্টিকে ডাকার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তারা ফ্যাসিবাদের দোসর। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রশাসনে নিরপেক্ষ লোক দরকার। ছাত্ররা যদি ডিসি এসপি নিয়োগ দেয় তাহলে তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচন নির্দলীয় করতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা