০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ৪ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ইএফডি জটিলতায় রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে এনবিআর

বছরে ৬০ হাজার মেশিন বসানোর কথা থাকলেও হয়েছে ১১ হাজার
-


রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে মেশিন ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এদিকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে দেখা দিয়েছে জটিলতা। সংশ্লিষ্টলা বলছেন সরকারের নতুন এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন এক বছরেরও বেশি সময়ে প্রত্যাশিত সাফল্য না আসায় ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসের (ইএফডি) বিকল্প খোঁজার নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর। প্রতি বছর ৬০ হাজার মেশিন বসানোর কথা থাকলেও তাতে ব্যর্থ হয়েছে পরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিস।
অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ভ্যাট আদায়ের ডিজিটাল মেশিন ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালুর চার বছর পরও অচলাবস্থা কাটছেই না। এনবিআর ও প্রকল্পের সহযোগী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসের ব্যর্থতায় ভ্যাট ব্যবস্থার ডিজিটাল প্লাটফর্মটি থমকে আছে। এনবিআরের অভিযোগ ক্রয় ও সেবা চুক্তি ভঙ্গ করেছে জেনেক্স। তবে পাল্টা এনবিআরের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগসহ অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে জেনেক্স। চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, এনবিআর কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, বিল বুঝে না পাওয়া, মার্কিন ডলারের দর বৃদ্ধি ও ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতার কারণে ভ্যাট ব্যবস্থার ডিজিটাল প্লাটফর্মটিতে অচলাবস্থা চলছে।

এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মেশিন আমদানিতে নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে জেনেক্সের বিরুদ্ধে। এমন অবস্থায় জেনেক্স ক্রয় ও সেবা চুক্তিও ভঙ্গ করেছে বলে দাবি করে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে নোটিশ পাঠিয়েছে এনবিআর।
এদিকে সাফল্য না আসায় ইএফডির বিকল্প ভাবছে এনবিআর। জেনেক্স ইনফোসিসের শর্ত লঙ্ঘন, মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অসহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইএফডি চালু না করায় ইএফডি প্রকল্পে সাফল্য আসেনি। এই পরিস্থিতিতে ইএফডি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সেই সাথে ইএফডি মেশিনের বিকল্প খুঁজে বের করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো: আবদুর রহমান খান।

এনবিআরের কর্মকর্তারা বলেন, বছরে ৬০ হাজার মেশিন সরবরাহের শর্ত থাকলেও জেনেক্স তা করতে পারেনি। কেন ক্রয় ও সেবা চুক্তি ভঙ্গ করেছে এর ব্যাখ্যা চেয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে শোকজ করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতি মাসে ইএফডি লটারির বিষয়টি ভোক্তা পর্যায় থেকে যথেষ্ট সাড়া না পাওয়ায় গত আগস্ট থেকে ইএফডি লটারি বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন আমরা ভ্যাট আহরণ ইএফডি মেশিনের মাধ্যমে সক্রিয় রাখবো নাকি ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাজ করব তা নিয়ে শিগগির সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সাথে আলোচনা হবে। অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির সাহায্যে অটোমেশনের কাজ করবে এনবিআর।
জেনেক্স ইনফোসিস পিএলসির করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের প্রধান আবু জাহিদ পরাগ দাবি করেন, এনবিআর থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি পাননি তারা। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এনবিআর থেকে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। আমরা এ প্রকল্পের মাধ্যমে খুচরা পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয় রাজস্ব উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত বিকাশে সক্রিয়ভাবে নিযুক্ত আছি। এনবিআর এই প্রকল্পের সফল অগ্রগতির জন্য কিছু পূর্বশর্ত বেঁধে দিয়েছে। যেগুলো আমরা বর্তমানে আরো কার্যকর ও সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে এনবিআরের সাথে আলোচনা করছি।
এদিকে গত ১৩ আগস্ট এনবিআর কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, বিল বুঝে না পাওয়া, মার্কিন ডলারের দর বৃদ্ধি ও ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতাসহ নানা অভিযোগ তুলে অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে জেনেক্স। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী শাহ জালাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, এই উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগের আশানুরূপ সুফল মিলছে না। কিছু খুচরা ব্যবসায়ী, এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও আন্তরিকতার অভাবে এই প্রকল্প লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে।
জেনেক্স এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রকল্প গ্রহণের সময় থেকে বর্তমানে মুদ্রার মানে যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। দরপত্র জমা দেয়ার সময় ডলারের দর ছিল ৮৫ দশমিক ৮৬ টাকা। বর্তমানে এই দর গিয়ে ঠেকেছে ১২০ টাকায়। বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যাংকগুলো থেকে এলসি খোলায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। এতে ডিভাইস আমদানির লক্ষ্যমাত্রা জটিল করে তুলেছে।

চিঠিতে জেনেক্স জানায়, তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও এনবিআর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে ইএফডি ডিভাইস। এসব কাজে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৪ কোটি টাকা। তবে এই বিলের টাকা এখনো বুঝে পায়নি তারা।
এনবিআরের বিভিন্ন নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের চুক্তির আওতায় কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাটের পাঁচটি কমিশনারেট এর আওতাধীন এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইএফডি ও এসডিসি সরবরাহ, সংস্থাপন ও মনিটরিংয়ের কাজ করার কথা জেনেক্স ইনফোসিসের। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট (ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, চট্টগ্রাম) ইএফডি ও এসডিসি স্থাপন কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়েছিল ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর। ডিজিটাল মাধ্যমে খুচরা পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট সংগ্রহ করতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন বসানোর কাজে গতি ফেরাতে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের সাথে চুক্তি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

প্রায় পাঁচ বছর আলোচনা ও পাইলট প্রকল্পের পর ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে খুচরা ব্যবসায় ইএফডি যন্ত্র বসাতে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের সাথে চুক্তি করে এনবিআর। লক্ষ্য ছিল প্রায় ২৫ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে ভ্যাট আদায় করা। তবে এক বছরে ইএফডি যন্ত্র বসিয়ে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।
সর্বশেষ তথ্যানুসারে, রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, বসুন্ধরা সিটি, মৌচাক, বেইলি রোডের কিছু দোকানে ইএফডি যন্ত্র থাকলেও, দোকানিরা তা ব্যবহার করেন না। জনপ্রিয় করতে ইএফডি কুপনের ওপর লটারির ব্যবস্থা করে এনবিআর, তবে সেই লটারিতেও আগ্রহ ছিল না ক্রেতাদের। গত ২২ আগস্ট ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করে ইএফডি যন্ত্রের বিকল্প চিন্তা করার নির্দেশনা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ভ্যাট উইং এ কিভাবে আরো বেশি অটোমেশন করা যায় তার রূপরেখা বের করার তাগিদ দিয়েছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকার রিটেইল আউটলেট থেকে তার প্রাপ্য ভ্যাট পাচ্ছে না। এজন্য এনবিআরকে শিগগিরই আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে একটি সহজ প্রযুক্তিগত সমাধান খুঁজে বের করতে তিনি পরামর্শ দেন।

তথ্যে দেখা যায় ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রারের (ইসিআর) মাধ্যমে ভ্যাট আদায় করা হতো। তবে ২০১৮ সালে ২৫ ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইএফডির মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ের উদ্যোগ নেয় এনবিআর। ব্যবস্থাটি এনবিআরের সার্ভারের সাথে যুক্ত রাখার কথা ছিল। কোনো পণ্য বিক্রির তথ্য এতে ইনপুট দিলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনবিআরে রক্ষিত সার্ভারে যুক্ত হবে এবং ভ্যাটের পরিমাণ দেখা যাবে এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।
তবে ভ্যাট ফাঁকি রোধের জন্য এই ব্যবস্থা চালু করতে পাঁচ বছর দেরি হয়। শুরুতে প্রায় এক বছর পরীক্ষামূলকভাবে কিছু প্রতিষ্ঠানে চালু হওয়ার পর গত বছরের আগস্টে জেনেক্স ইনফোসিসের মাধ্যমে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দেয় এনবিআর। বছরে ৬০ হাজার এবং পরের পাঁচ বছরে তিন লাখ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এই মেশিন স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও মাত্র ১৫ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এসেছে ইএফডির আওতায়।
শুরুর আগে থেকেই ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে জেনেক্স ইনফোসিসের সাথে চুক্তি নিয়ে আপত্তি ছিল। তারা জানান, শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি না করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করলে এনবিআর উপকৃত হতো। একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেলে সেখানে কোনো জবাবদিহি থাকে না এবং স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ থাকে। এ ছাড়া চুক্তির প্রক্রিয়া নিয়েও কথা বলেছেন অনেকে।

 


আরো সংবাদ



premium cement