২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সুন্দরবনে বেড়েছে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে, ধারণা বনবিভাগের

- ছবি : নয়া দিগন্ত

সর্বশেষ শুমারিতে বাঘের সংখ্যা বাড়ার আভাস মিললেও সোমবার (২৯ জুলাই) পালিত বিশ্ব বাঘ দিবসে এর ফলাফল ঘোষণা করতে পারেনি বনবিভাগ ও এর সাথে সংশ্লিষ্টরা। বাঘের প্রাকৃতিক আবাস রক্ষা এবং এই প্রাণী সংরক্ষণের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রতি বছরের ২৯ জুলাই দিবসটি পালন করা হয়।

২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ অভিবর্তনে এ দিবসটির সূচনা হয়। প্রাণিবিদরা বাঘকে বিড়াল জাতীয় বা ক্যাট গ্রুপের প্রাণী হিসেবে বর্ণনা করেন। এক সময় পৃথিবীতে বাঘের নয়টি উপপ্রজাতি ছিল। বর্তমানে টিকে আছে ছয়টি। সুন্দরবনের বাঘের বৈজ্ঞানিক নাম ‘প্যান্থেরা টাইগ্রিস’। গাঢ় ডোরাকাটা দাগ এর অনন্য বৈশিষ্ট্য।

সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ নিজ নিজ দেশে বাঘের সংখ্যা ১২ বছরের মধ্যে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়েছিল। এর মধ্যে নেপাল বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। ভারত এবং ভুটানও দ্বিগুণের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা সামান্য বাড়লেও সে লক্ষ্য থেকে দূরে রয়েছে।

দিবসটির এবারের মূল আকর্ষণ ছিল বাঘশুমারির ফলাফল প্রকাশ। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কারফিউর কারণে সব কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় আগামী আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ফল ঘোষণা করা হবে বলে দাবি বন কর্মকর্তাদের।

শুমারির প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ জরিপে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির আভাস মিলেছে বলে জানানো হয়েছে।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জে শুমারি হয়। প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের প্রথম দিকে সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জেও একই পদ্ধতিতে শুমারি করা হয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর দুপুরে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে বাঘ গণনার জরিপ কাজের উদ্বোধন করেন সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার।

৪০ দিন ধরে প্রতিটি রেঞ্জের ১৪৫টি পয়েন্টে দু’টি করে ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। প্রকল্পে মোট এক হাজার ২১৬টি ক্যামেরা নিয়ে ৪৫ জনের একটি গবেষক দল বাঘ গণনার কাজ সম্পন্ন করে। এছাড়া সুন্দরবনে খাল সার্ভের মাধ্যমে বাঘের পায়ের ছাপ সংগ্রহ করা হয়। প্রায় চার মাস আগে সম্পন্ন হয়েছে শুমারির মাঠ পর্যায়ের কাজ।

বন বিভাগের তথ্যে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালে জরিপে ৪২৫টি এবং এর দু’বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে দাঁড়ায় ১০৬টি। হঠাৎ করে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪০০টি থেকে ১০৬টিতে এসে দাঁড়ালে সারাবিশ্বে হইচই পড়ে যায়। ২০১৮ সালের সর্বশেষ বাঘশুমারিতে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪টিতে।

প্রাণী ও পরিবেশবাদীদের মতে, বাঘ সারাবিশ্বে একটি বিপন্ন প্রাণী। তথ্য মতে, বর্তমানে বিশ্বের ১৩টি দেশে তিন হাজার ৮৪০টি বাঘ প্রকৃতিতে রয়েছে।

বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প পরিচালক ও সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, শুমারিতে বাঘের প্রায় সাড়ে সাত হাজার ছবি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একই বাঘের ছবি পাওয়া গেছে বহুবার। এ জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতিটি বাঘের ‘ইউনিক আইডি’ করা হয়েছে। এসব ছবি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। তারা সেগুলো বিশ্লেষণ করছেন।

তিনি জানান, সাম্প্রতিক আন্দোলন কেন্দ্রীক জটিলতায় বেশ কিছু দিন ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় গণনার কাজ শেষ করা যায়নি। মেইলে তথ্য আদান-প্রদান কিংবা সংশ্লিষ্টদের পরষ্পর অনলাইনভিত্তিক জুম মিটিং করতে না পারার কারণে বাঘ দিবসে বাঘশুমারির ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আগস্টের ১৫ তারিখের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা যাবে।

তিনি আরো বলেন, ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করা হয়েছে। এক হাজার ২১৬টি ক্যামেরা নিয়ে প্রায় ৪৫ জনের একটি গবেষক দল বাঘ গণনার কাজ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনে লবণাক্ত এলাকা থেকে যে এলাকায় লবণ কম সেখানে বাঘের ছবি অনেক বেশি পেয়েছি। গত দু’টি জরিপে খুলনা রেঞ্জে বাঘের ছবি কম ছিল, কিন্তু এবারের জরিপে খুলনা রেঞ্জে প্রচুর বাঘের ছবি পেয়েছি। যেটা সুন্দরবনের মোট বাঘের সংখ্যায়ও ইতিবাচক প্রভাব রাখবে।’

পশ্চিম বন বিভাগের এই কর্মকর্তা আরো জানান, ২৯ জুলাই এবারের বাঘ দিবসে শুমারির তথ্য প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু কোটা আন্দোলন ও কারফিউর কারণে সব কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। সে জন্য আগামী মাসে ফল ঘোষণা করা হবে।

বন বিভাগ জানায়, এর আগে ২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে করা শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। এবার এই সংখ্যা বাড়বে বলেও ধারণা করছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সারা পৃথিবীতে এখন বাঘের যত উপপ্রজাতি রয়েছে, তাদের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ তুলনায় ছোট। স্বাভাবিকভাবে এর ওজনও কম। সুন্দরবনের স্ত্রী জাতীয় বাঘের গড় ওজন ৭৫ থেকে ৮০ কেজি। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে পাওয়া স্ত্রী বাঘের গড় ওজন ১৩৫ থেকে ১৪০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

সুন্দরবনে প্রথম পাগমার্ক পদ্ধতিতে বাঘ জরিপের কাজ শুরু হয় ২০১৩-১৪ সালে। ওই জরিপে সুন্দরবনে মোট ১০৬টি বাঘের অস্তিত্ব ছিল।


আরো সংবাদ



premium cement