২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মুমিনের কারাজীবনের অন্তরালে

-

প্রাজ্ঞ ও হকপন্থী মুমিনের কারান্তরীণ হওয়ার ঘটনায় সমৃদ্ধ ইসলামের ইতিহাস। একজন প্রাজ্ঞ আলেম কখনো অন্যায়ের বিরোধিতা না করে নির্বিকার থাকতে পারেন না। যুগে যুগে তারা সর্বস্ব ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল করে রেখেছেন নিজেদের জীবনপঞ্জী। এমন একজনও ন্যায়বাদী আলেমের কথা আমাদের জানা নেই যে, তিনি কারান্তরীণতা বরণ করেননি। আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার (১২২৮-১৩৬৩ খ্রি:) কথাই ধরা যাক। তিনি যখন শরিয়তের অবিকৃত ব্যাখ্যায় অনড়তা প্রদর্শন করছিলেন, তখন তাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে জেলজীবন সম্পর্কে তার অনুভূতি ও বক্তব্য আমাদের সমান্তরালভাবে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। ইবনে তাইমিয়ার জেল প্রবেশের মুহূর্তে দেয়া তার নিম্নোক্ত বক্তব্য ও স্রষ্টাভিমুখী মনোভাব আমাদের যেমন অফুরন্ত অনুপ্রেরণায় ঋদ্ধ করে তেমনি বিপদসঙ্কুল ঈমানী পথ চলাকে আলোকিত করে। তার সে বক্তব্য ছিল নিম্নরূপÑ
তিনি প্রথমে আল-কুরআনের এ আয়াতটি তেলাওয়াত করেন : যার অর্থÑ তখন তাদের (মুনাফেক ও মুমিনদের মধ্যে) একটি দরোজাবিশিষ্ট পৃথককারী দেয়াল সৃষ্টি করা হলো। এ দেয়ালের অভ্যন্তরভাগে রয়েছে আমার রহমত (জান্নাত) আর বহির্ভাগে রয়েছে কঠিন আজাব (জাহান্নাম)। [সূরা আল-হাদীদ-১৩] অতঃপর তিনি বললেন : আমার শত্রুরা আমাকে আর কিইবা করতে পারবে! আমি তো এমন এক মানুষ যে নিজের অন্তরে বহন করে চলি আমার জান্নাত, আমার ভালোলাগার উদ্যান। আমার সাথে আছে আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সা:-এর সুন্নাত। আমার হত্যায় আমার শাহাদাত। আমার নির্বাসনে আমার পর্যটনান্দ। আমার কারারুদ্ধতায় নিহিত আছে আপন রবের সাথে একাকী মিলনের আনন্দ। প্রকৃত বিচারে রুদ্ধ সে-ই যে তার প্রভুর যোগ-প্রাপ্তি থেকে রুদ্ধ থাকে। আর যে ব্যক্তি আপন প্রবৃত্তির হাতে আটক থাকে সে-ই তো প্রকৃত বন্দী। অতঃপর একপর্যায়ে তাকে যখন তৎকালীন সুলতানের ফরমান শুনানো হলো, তখন তিনি বললেন : শপথ মহান আল্লাহর; আমার মনে যে পরিমাণ আনন্দ বিরাজ করছে তা যদি শাম অঞ্চলের তাবৎ মানুষের মধ্যে ভাগ করা হতো, তবে তারা সবাই আনন্দাবৃত হতে পারত। আল্লাহর কসম আমি নরম পশমাবৃত ছাগলছানার মতো, যেখানেই যাই, যেথায় থাকি সেখানে এবং সেথায় আমার জন্য নম্রতার পরশ বিরাজ করে। তারা আমাকে যদি (দূরবর্তী) সাইপ্রাসেও নির্বাসিত করে, আমি সেখানকার অধিবাসীদের ইসলামের পথে দাওয়াত দেবো। তারা যদি আমাকে জেলবন্দী করে, তখন আমি আমার মহান রবের এবাদতে আত্মনিমগ্ন হবো, আর যদি হত্যা করে তখন (দ্বিধাহীনচিত্তে) আমি বহুকাক্সিক্ষত শাহাদতের অমিয় শুধা পান করে নেবো।
মূলত আখেরাতমুখী মানবসত্তার মনোজগৎ আমাদের চিরচেনা জীবনাচরণের উত্তীর্ণতায় বিচার্য। আমরা যেসব বিষয়ে আনন্দপ্রীতি খুঁজে পাই তারা কখনো তার ঠিক উল্টো পথে চলার মধ্যে নিজেদের জীবনার্থ খুঁজে নেন। ইসলামের দুনিয়াতত্ত্ব তা-ই বলে এবং এর আলোকেই মুমিন জিন্দেগীকে গড়তে উৎসাহিত করে। যদি তা-ই না হতো তবে প্রায় অর্ধেক পৃথিবীর শাসক হজরত ওমার রা: তালি দেয়া অত্যন্ত সাধারণ পোশাক পরে, ক্ষীণকায় এক উঠের পিঠে আরোহণ করে বাইতুল মাকদিসের চাবি ও কর্তৃত্ব গ্রহণ করতেন না। তাকে একটু মানসম্পন্ন পোশাক পরার এবং একটি তেজস্বী বাহনের প্রস্তাব করা হলে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন : ‘আমরা সেই জাতি, যাদেরকে আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। সুতরাং আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কিছু গ্রহণ করতে আমরা রাজি নই।’
তাই একজন মুমিন তার সব কর্মতৎপরতায় ইসলামকেন্দ্রিকতার পৃষ্ঠপোষকতা ও বিস্তারে সক্রিয় থাকেন। তাকওয়ার ভিত্তিতে তার জীবনের মূল পর্ব তথা পরকালীন জীবনের সুখ-দুঃখের ফায়সালা হবেÑ এ সত্যটি তার কাছে প্রকৃত সত্য, আর অন্য সবকিছুই মিথ্যা-প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং তাদের জীবনধারার অনেক কিছুই আমদের মতো জীবনবাদীদের কাছে কখনো অচেনা-অদ্ভুত লাগে।
যদি তা-ই না হতো তবে আমরা কেন পার্থিব বিবেচনায় এসব মানুষকে নির্বোধ আখ্যা দেই এবং অনেক ক্ষেত্রে হাসি-তামাশার মনরোচক উৎসে পরিণত করি। অথচ জগৎস্রষ্টা-প্রণীত বিধানের মর্মকথায় এসব মানুষের সম্মান ইহলোকোত্তীর্ণ করে সপ্তাকাশস্পর্শী হওয়ার কথা রয়েছে।
আমরা আমাদের চর্মচোখ দিয়ে যাদের চলনে-বলনে বক্রতা, পোশাক-আশাকে অরুচি দেখি তারাই যে একদিন আমাদের দুঃসহ পরিণতি দেখে হাসবেÑ হয়তো আমাদের এ তথ্য জানা নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন : ‘আজ যারা অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে, তারা দুনিয়ায় মুমিনদের নিয়ে হাসি-তামাশা করত। মুমিনরা পাশ দিয়ে গেলে তারা পরস্পরকে টিপ্পুনি কাটত। (শুধু তাই না) তারা যখন নিজ পরিবারের কাছে ফিরে যেত, তখনও তারা এদের নিয়ে রসাত্মক গল্পে মেতে থাকত। তারা তো এদের দেখলে বলত এরা তো দেখি সবাই পথভ্রষ্ট। অথচ এদের (বিদ্রƒপকারীদের) মুমিনদের রক্ষা কিংবা তাদের ওপর খবরদারি করার জন্য (দুনিয়াতে) পাঠানো হয়নি।’ [আল-মুতাফ্ফিফিন :২৯-৩৩]
তাই তো একজন মুমিন তার অন্তরস্থ ঈমানের আলোয় জুলুমরূপী সব অন্ধকার দূর করেন এবং উৎরে যান ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়ার সব কাঠিন্য ও রূঢ়তাকে। সুতরাং মুমিনকে পরাজিত, পরাস্থ কিংবা সেকেলে বলার আগে তার মনস্তত্ত্ব পাঠের প্রয়োজন আছে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন।
লেখক : প্রফেসর ও সভাপতি, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


আরো সংবাদ



premium cement