২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঈমান হৃদয়কে সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে তোলে

-

মানব হৃদয়ে ঈমান প্রবেশের ফলে তা সব সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠে। এক ব্যক্তি নবী করিম সা:-কে প্রশ্ন করেছিলেন : হে আল্লাহর নবী! মানুষের মধ্যে কোন ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা বিচক্ষণ? এ প্রশ্নের উত্তরে নবী করিম সা: বলেন : মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ সেই যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর কথা ভাবে এবং যথাযথভাবে তার জন্য তৈরি হয়। জেনে রাখো, যখন ইসলাম মানব হৃদয়ে প্রবেশ করে তখন তা প্রশস্ত ও কূটিলতা বিবর্জিত হয়। তখন সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা:কে এর আলামত কী তা জানতে চান। তখন রাসূল সা: তাদের বলেন : এর আলামত হলোÑ সে পরকালীন জীবনের দিকে ধাবমান হবে, অলীক অহংবোধ ও নশ্বর এ দুনিয়াকে এড়িয়ে চলবে আর মৃত্যু সমাগত হওয়ার আগেই এর প্রস্তুতি নিতে থাকবে। (আল-হাকিম-আল মুস্তাদরাক: ৪/৩৪৬ নং-৭৮৬৩)
এ কারণে রাসূল সা:কে বিশ্বমানবতার জন্য হেদায়াতের আলোকবর্তিকাস্বরূপ আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ কথাটি সব প্রকৃত মুমিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই যে মুমিন হৃদয় পৃথিবীর মানুষের জাত-পাত, ভাষা-সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচারের বৈচিত্র্যময়তাকে আত্মস্থ করতে পারে না এবং নিজেকে বিশ্বাত্মবোধক এক সর্বমানবিক ও উদার সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে না, সে আর যাই হোক ঈমানদ্বীপ্ত হৃদয়ের অধিকারী নয়। যে মুমিন-হৃদয় মৃত্যু-পরবর্তী আখেরাতের জীবনকে তার চিন্তা ও চেতনার মর্মকেন্দ্রে প্রতিস্থাপন করবে না এবং তার সমুদয় আচার আচরণ তদানুযায়ী পরিচালিত করবে না; এমন মুমিনের ঈমান-দ্বীপ্ততা মানোত্তীর্ণ নয়।
একজন দ্বীপ্তিমান মুমিন পৃথিবীর অর্থহীনতা দৃষ্টে সর্বদা বিচলিত থেকে নির্লিপ্ততার পথ বেছে নেন। তার বিবেচনায় রাসূল সা: ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনধারাকে সর্বদা চোখের সামনে রেখে স্বীয় জীবন চলার পথে তা বাস্তবায়ন করেন। তিনি এ দুনিয়ার অন্তঃসারশূন্যতার কথা মনে করে দুনিয়ায় আয়েশী জীবনযাপন না করে তার পরিবর্তে দুনিয়ার অভ্যন্তরভাগের অন্ধকার কবরে আয়েশী জিন্দেগির আয়োজনে ব্যস্ত থাকেন।
রাসূল সা: একবার পরিত্যক্ত একটি পচে যাওয়া ছাগদেহ দেখে সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেন : নিশ্চয় এ ছাগলটি তার মালিকের কাছে মূল্যহীন বলেই এটিকে এভাবে ফেলে রেখেছে! তখন সাহাবায়ে কেরাম হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেন। তখন আল্লাহর রাসূল সা: তাদের উদ্দেশে বললেন : আল্লাহর কসম এই পচে যাওয়া ছাগলটি তার মালিকের কাছে যতটুকু মূল্যহীন তার চেয়েও এ দুনিয়া আল্লাহর কাছে অধিকতর মূল্যহীন। (তিরমিজি : ২৩২১, ইবনু মাজাহ : ৪১১১)
অপর একটি হাদিসে রাসূল সা: বলেন : এ দুনিয়া যদি আল্লাহর কাছে একটি মশার ডানার সমমূল্যের হতো, তবে তিনি কাফেরদের এক ফোঁটা পানিও খাওয়াতেন না। (তিরমিজি : ৫৬০/৪ নং-২৩২০)
একজন মুমিন আল্লাহর ভালোবাসার পারস্পরিকতায় ও অনুভবে সর্বদা বিমুগ্ধচিত্ত। তিনি তার রবের সান্নিধ্যে সব সুখানুভূতির অমিয়ধারায় আত্মস্নাত হতে ব্যাকুল থাকেন। সৃষ্টি জগতের বিচিত্রতার পরতে-পরতে খুঁজে পান তার উপস্থিতি। আপন রবের স্নেহ-মমতাভরা কথা ও কর্মকুশলতা তার হৃদয়ের গহিনতাকে স্পর্শ করে। তাই তার হৃদয় মনুষ্য কোনো কথা কিংবা কর্মকুশলতায় নির্মোহ ও নির্লিপ্ত থাকে। কেননা তিনি ঈমানের বলে চর্মচোখের দৃষ্টিসীমাকে উত্তীর্ণ করে হৃদয়েব চোখ দিয়ে মূর্তিমান জগতের অন্যরূপ প্রত্যক্ষ করেন। একদা রাসূল সা: বিশিষ্ট সাহাবি হজরত হারিসাকে রা: প্রশ্ন করলেন : হে হারিসা, তোমার মনের অবস্থা কেমন? জবাবে তিনি বললেন : হে আল্লাহর রাসূল, আমার মন দুনিয়াবিমুখ হয়ে পড়েছে। তাই আমার রাত (এবাদতে) বিনিদ্র কাটছে, আমার দিন থাকছে (রোজায়) তৃষ্ণার্থ। আমি যেন স্পষ্টভাবে রোজ কিয়ামত দিবসে রহমানের আরশকে হিসাবের জন্য পৃথিবীতে নামিয়ে আনা হয়েছেÑ এ দৃশ্য অবলোকন করতে পারছি। আমি দেখতে পাচ্ছি জান্নাতবাসীরা পরস্পর আনন্দ-মেলায় বসেছে, অপর দিকে জাহান্নামিদের আর্তচিৎকারও শুনতে পাচ্ছি। এ কথা শুনে আল্লাহর রাসূল সা: বললেন : তুমি আল্লাহর সেই বান্দা যার অন্তরে আল্লাহ তায়ালা ঈমানের নূর প্রজ্ব¡লিত করেছেন। অন্য রেওয়াতে আছে : তুমি ঈমানী উৎকর্ষ লাভ করেছ, এটা ধরে রাখো। (তাবারানি : আল-কাবির : ৩৩৩৬৭)
এভাবে একজন ঈমানদার অক্ষর-বন্দি কুরআন-হাদিসের কথামালার জীবন্ত ও প্রত্যক্ষণযোগ্য অনুধাবনে নিজের দেহ-মনের প্রশান্তি সাধন করেন।
লেখক : প্রফেসর ও সভাপতি, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

 


আরো সংবাদ



premium cement