সিয়ামেই হোক ক্রান্তিলগ্নের পরিসমাপ্তি
- মাওলানা নজরুল ইসলাম
- ২৬ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০
রোজা ইসলামের অন্যতম একটি মূল ভিত্তি। অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে লৌকিকতার সুযোগ থাকলেও রোজার ক্ষেত্রে তার সুযোগ নেই। রোজা হয় একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তাই এর মাধ্যমে তাকওয়ার মাপকাঠিতে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানো সম্ভব। মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছানোর এক কাক্সিক্ষত মাধ্যম হলো রোজা। প্রাপ্তবয়ষ্ক, সুস্থ সব মুসলমানের জন্য রোজা রাখা ফরজ। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)। রোজা যেমন মানুষকে দেয় শারীরিক সুস্থতা, তেমনি মানসিকভাবেও রাখে প্রফুল্ল। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ^জুড়েই যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, রোজা এ সময়ে মুমিনদের মানসিক প্রশান্তি ও দৃঢ়তা এনে দিতে সক্ষম। আর কিভাবে তা মুমিনদের মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে তার একটি বাস্তব নমুনা ব্রিটিশশাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর কর্নেল এলবার্ট রেমস এল সি তখন আটক কেল্লায় (বর্তমানে পাকিস্তানের আটক জেলায় অবস্থিত) দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেদিন কর্নেল এল সি তার অফিসে বসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে যায় খোলা জানালা পথে সামনের প্যারেড গ্রাউন্ডে। তিনি সেখানে দেখেন একজন ইন্ডিয়ান সৈন্যকে শাস্তি স্বরূপ প্যারেড গ্রাউন্ডে দৌড়ানো হচ্ছে। তাকে শাস্তি দেয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছে এক শিখ সৈন্য। শাস্তি স্বরূপ ইন্ডিয়ান সৈন্যটির পিঠে বেঁধে দেয়া হয়েছে ইটের একটি বিরাট বোঝা। খড়তপ্ত দুপুরে সৈন্যটিকে দৌড়ানো হচ্ছে পূর্ণ গতিতে। দৌড়াতে দৌড়াতে যখনই তার দেহের গতিতে কিছুটা শিথিল ভাব আসে, তখনই তার পিঠে নেমে আসে শিখ সৈন্যের লিকলিকে বেত। এভাবে দৌড় চলতে থাকে এক ঘণ্টা ধরে। বেলা ৩টা বেজে যায়। তাকে থামিয়ে দেয় শিখ সৈন্যটি। ছুটি দেয় কিছুক্ষণের জন্য। কর্নেল এল সি হাতের কাজ রেখে এ দৃশ্য দেখছিলেন মনোযোগের সাথে। ইন্ডিয়ান সৈন্যটি ছুটি পাওয়া মাত্রই দৌড়ে গেল পানির নলের দিকে। হাত দুটি কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে মুখে পানি নিলো। কিন্তু পানি পান না করে মুখে নিয়ে এমনভাবে নাড়াচড়া করল যেন পানি গলার নিচে নেমে না যায়। এভাবে তিনবার মুখে পানি নিলো অথচ পান না করে ফেলে দিলো। এরপর মুখ পরিষ্কার করল তিনবার। তারপর হাত দুটি কনুই পর্যন্ত ধুয়ে ভেজা হাত দিয়ে মাথায় বুলাল। সবশেষে তিনবার পা ধুয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে এলো প্যারেড গ্রাউন্ডে। জলন্ত চুলার মতো উত্তপ্ত মাটিতে পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। উঠা-বসা করল নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট সংখ্যক বার। এই উঠা-বসা শেষ না হতেই মৃত্যু ফেরেশতার রূপ নিয়ে সেই শিখ সৈন্যটি তার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল লিকলিকে বেত হাতে নিয়ে। সুতরাং সেই ইন্ডিয়ান সৈন্যটি আগের মতোপূর্ণ গতিতে দৌড়াতে লাগল। ভেঙে গেল কর্নেল এল সির ধৈর্যের বাঁধ। নিজ অফিস কক্ষ থেকে বের হয়ে তিনি চলে গেলেন ইন্ডিয়ান ইউনিটের দফতরে। দেখা করলেন সমপর্যায়ের অফিসারের সাথে। বললেন, সামনের ওই প্যারেড গ্রাউন্ডে এক দেশী সৈন্যকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কী অপরাধ তার? এত প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও লোকটি এক ঢোক পানি পান করেনি। তিনি দেশী সৈন্যটির সৎ সাহসের প্রশংসা করলেন এবং তার অপরাধ ক্ষমা করে দেয়ার সুপারিশ করলেন। সেই সাথে অনুরোধ জানালেন, সেই সৈন্যকে তার কাছে নিয়ে আসার জন্য। তার অনুরোধে সৈন্যটিকে তার কাছে নিয়ে আসা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে কি জন্য এই শাস্তি দেয়া হচ্ছে? সৈন্যটি উত্তর দিলো, আজ সকালে পিটি মেসে পৌঁছতে আমার দু’-তিন মিনিট দেরি হয়েছে। আমাদের কমান্ডার একজন শিখ ক্যাপ্টেন, তিনি মুসলমানদের ব্যাপারে খুব বাড়াবাড়ি করে থাকেন। আমাদের সামান্য কোনো ত্রুটি পেলেই ভীষণ শাস্তির ব্যবস্থা করেন। কর্নেল এল সির দ্বিতীয় প্রশ্ন, এত প্রচণ্ড গরম আর কঠিন শাস্তি ভোগের পরও কি তোমার পানি পিপাসা লাগেনি? আমি তো তোমাকে পানি পান করতে দেখলাম না!
বরং দেখলাম তুমি মুখে পানি নিয়ে আবার ফেলে দিচ্ছ! সৈন্যটি বলল, আমি যেহেতু একজন মানুষ এত প্রচণ্ড গরমে পানির তৃষ্ণা জাগবে এই তো স্বাভাবিক। তবে আমি একজন মুসলমানও। এখন রমজান মাস। আর এ মাসটিতে মুসলমানরা রোজা রাখে, আমিও রেখেছি। তাই প্রচণ্ড পিপাসা সত্ত্বে¡ও আমি পানি পান করিনি। কর্নেল এল সি বললেন, দেখোÑ তুমি যদি এই অবস্থায় পানি পান করতে তাহলে কেউ তো দেখত না। কাজেই অসুবিধা কী ছিল? সৈন্যটি জবাব দিলো, আমি যদি এই অবস্থায় পানি পান করতাম তাহলে কোনো মানুষ হয়তো আমাকে দেখত না বা দেখলেও বাধা দিত না। কিন্তু আমার সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামিন তো দেখতেন। কারো সাধ্য নাই যে, তার নিজস¦ কর্মকাণ্ড আল্লাহ পাকের দৃষ্টির আড়ালে করবে কিংবা গোপন রাখবে। এ কথা শুনে কর্নেল এল সি অবাক হয়ে গেলেন। এ ঘটনা তাকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, শেষ পর্যন্ত তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। (কেন মুসলমান হলাম, দ্বিতীয় খণ্ড) এভাবেই রোজা মুমিনদের তাকওয়া বৃদ্ধি করে বাস্তবিক অর্থেই নানা প্রতিকূল পরিবেশেও দিয়ে থাকে মানসিক প্রশান্তি। তাই সারা বিশে^র এই ক্রান্তিলগ্নে, মানবিকতা যখন অধঃপতিত, উৎকণ্ঠিত-বিচলিত মানবসমাজ, এই মুহূর্তে সেই সৈন্যর মতো ঈমানি দৃঢ়তা আর সিয়াম সাধনা মুমিন হৃদয়ে এনে দিতে পারে অনাবিল প্রশান্তি। রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের সুমহান বাণী নিয়ে শুরু হয়েছে মাহে রমজান। মহান আল্লাহ রমজানকে কেন্দ্র করে সব বালা-মুসিবত দূরীভূত করে পুরো বিশ^কে তার রহমতের চাদরে আবৃত করুন। আমিন।
লেখক: খতিব, জান্নাতুল মাওয়া জামে মসজিদ, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড, গাজীপুর সিটি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা