করোনা মোকাবেলায় ইসলামের নির্দেশনা
- ড. ইকবাল কবীর মোহন
- ২২ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০
করোনাভাইরাস রোগ বা কোভিড-১৯ মহামারী সারা দুনিয়াকে থমকে দিয়েছে। দুনিয়ার ২১০টি দেশে এই ভাইরাসে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ, কেড়ে নিয়েছে দেড় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ। পরীক্ষার আওতায় না আসায় আরো কত মানুষের দেহে যে এই ভাইরাস বাসা বেঁধেছে তার হিসাব কেউ জানে না। আক্রান্ত ও প্রাণহরণের সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কারো কারো মতে কোনো কোনো দেশে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। ফলে ভয়-আতঙ্ক আর চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে গোটা বিশে^র মানুষ এখন হতবাক। গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে বিশে^র প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি মানুষ। কল-কারখানাগুলো এখন সচল নেই । নেই শ্রমিক-মালিকের কোলাহল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পদচারণা নিঃসীম নীরবতায় হারিয়ে গেছে। মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা, মন্দিরগুলো শূন্যতায় হাহাকার করছে। অর্থনীতির চাকা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে বেকারত্ব বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। তাই চার দিকে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এখন থেমে গেছে শক্তির লড়াই, বন্ধ হয়েছে যুদ্ধ। হানাহানি আর বিরোধ নিয়ে নেই মাতামাতি। পরাশক্তিগুলোর দম্ভ ও অহঙ্কার মাত্র তিন মাসে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়েছে। পরমাণু শক্তির দেশগুলো এতটাই অসহায় যে, তারা অদৃশ্য করোনাভাইরাসকে রুখতে পারছে না। আচমকা বদলে যাওয়া দুনিয়ার উল্লাস আর রোমান্টিকতার কেন্দ্রগুলো করোনার আঘাতে এখন বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এরই সাথে মানবিকতারও অবিশ^াস্য বিপর্যয় ঘটেছে দেশে দেশে, সমাজে ও পরিবারে। মানুষ মানুষকে এখন ভালোবাসা ও আদরের স্পর্শে জড়িয়ে ধরে না। যে যতটা পারছে দূরে থাকার অমানবিক পথ বেছে নিয়েছে। অথচ এ সময় বিশে^ ভিন্ন একটা চিত্র চোখের আড়ালেই ঘটে গেছে। এখন বাতাসে নেই বারুদের গন্ধ, নেই কার্বন নিঃসরণের ভয়ানক দূষণ। শব্দদূষণও নেমে গেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। নদী-সাগর ও মহাসাগরে দাবিয়ে বেড়ানো দাম্ভিক পরাশক্তির পদচারণা এখন বন্ধ। তাই নিস্তরঙ্গ পানিতে নেই ঢেউয়ের উন্মাতাল গর্জন। পশু-পাখি, গাছপালা, আকাশ, বাতাস সবই এখন ভালো আছে। করোনা মহামারী দুনিয়ার মানুষকে একটাই বার্তা যেন দিচ্ছেÑ ‘হে মানুষ তোমরা যতই অহঙ্কার করো বা শক্তি দেখাও, তোমরা আসলেই শক্তিহীন। আল্লাহর শক্তিই বড় শক্তি। তাঁর ক্ষমতার কাছে তোমরা তুচ্ছ। তাই শক্তি, দম্ভ ও জুলুমের পথ পরিহার করো। এবার ক্ষান্ত হও। ফিরে এসো সরল-সোজা পথে।’
এরই প্রেক্ষাপটে তো থেমে থাকলে চলবে না। ভয়ঙ্কর মহামারী করোনা থেকে বাঁচার জন্য চাই যথাযথ সতর্কতা, চাই দরকারি চিকিৎসা। এ জন্য বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করোনা থেকে রক্ষার জন্য কতগুলো সতর্কতামূলক নিয়ম-পদ্ধতি (পরিচ্ছন্ন থাকা, হাত ধোয়া, হাঁচির সময় নাক-মুখ ঢাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা) জারি করেছে। পাশাপাশি সাধ্যমতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, মানুষের তৈরি এই বিধানগুলো ১৪০০ বছর আগেই ইসলাম বাতলে দিয়েছে। আমরা এই প্রবন্ধে এ বিষয়গুলোর সাথে মহামারী মোকাবেলায় মানুষকে আর কী কী বিধান মেনে চলতে হবে, তা নিয়ে আলোচনা করব।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা : করোনাভাইরাস থেকে রক্ষার উপায় হিসেবে সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলা হচ্ছে। পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী সা: বলেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (পবিত্রতা) ঈমানের অর্ধেক’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস-৪৩২)। ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের আগে পবিত্রতা (পরিচ্ছন্নতা) অর্জন অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। যেমন নামাজ পড়া, কুরআন স্পর্শ করা এবং কাবাঘর তাওয়াফের আগে অজু করতে বলা হয়েছে। অজু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম। অজুর মধ্যে রয়েছে হাত, মুখ, নাক, মুখমণ্ডল ও পা ধোয়ার বিধান। পরিচ্ছন্নতার আরেকটি উপায় হলো গোসল। শুক্রবার জুমার নামাজে যাওয়ার আগে গোসল করতে মহানবী সা: মুসলমানদের উৎসাহ দিয়েছেন। আমরা মুখ ও দাঁত পরিষ্কার করার জন্য আজকাল টুথব্রাশ ও টুথপেস্ট ব্যবহার করি। অথচ ইসলাম ‘মিসওয়াক’ (এক প্রকার গাছের ডাল) দিয়ে মুখ ও দাঁত পরিষ্কার করার বিধান ঘোষণা করেছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা (পরিচ্ছন্নতা) অর্জনকারীকে’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২২২)।
হাত ধোয়া : ইসলাম হাত ধোয়ার প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘ঘুম থেকে ওঠে তোমরা হাত ধৌত করো, কেননা, তোমরা জানো না, ঘুমের মধ্যে হাত কোথায় স্পর্শ করেছে’ (সহিহ মুসলিম, ৫৪১)। তা ছাড়া মুসলমানরা ফজরের নামাজের আগে অজু করার সময়ও হাত ধুয়ে থাকে। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে মুসলমানরা অন্তত পাঁচবার অজু করেন। কেউ কেউ তো কুরআন পড়া বা অন্য ইবাদত করার জন্যও অজু করেন। আবার প্রতিটি অঙ্গ তিনবার ভালোভাবে ধৌত করার বিধান রয়েছে শরিয়তে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘তোমরা হাতের আঙুলের ফাঁকগুলো ধৌত করো’ (সহিহ মুসলিম, ৫০২)। মজার ব্যাপার হলো বর্তমান করোনা মহামারীর সময় এভাবে হাত পরিষ্কার করার কথা বলা হচ্ছে বারবার। অথচ ১৪০০ বছর আগে থেকেই ইসলামের এই বিধান চালু রয়েছে।
হাঁচির সময় নাক ঢাকা : সর্দি লাগা মানুষের হাঁচির মাধ্যমে নানা রোগজীবাণু দ্রুত আশপাশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং অন্যরাও সহজেই সর্দি বা অন্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো ভয়ঙ্কর জীবাণু অতি দ্রুত হাঁচির মাধ্যমে সুস্থ মানুষকে আক্রান্ত করে। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে হাঁচির সময় কাপড়, টিস্যু বা হাত দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখার কথা বলা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মহানবী সা: হাঁচির সময় হাত বা কাপড় দিয়ে নাক ও মুখে চেপে ধরতেন’ Ñ(আবু দাউদ, ৫০১১)।
সামাজিক আটকাবস্থা : সোশ্যাল কোয়ারেন্টিন মানে রোগসংক্রমণ থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখা বা আটকাবস্থায় থাকা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ^জুড়ে এটি এখন সর্বোত্তম উপায় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিস্ময়কর বিষয় হলো, মহানবী সা: এই নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা যদি কোনো এলাকায় প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কথা শুনতে পাও, সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর প্লেগ ছড়িয়ে পড়া অবস্থায় তুমি যদি সেই এলাকায় থাকো, তা হলে সেই স্থান ত্যাগ করো না’ (সহিহ বুখারি, ৬২৪)। অন্য একটি হাদিসে মহানবী সা: একই কথা বলেছেন, ‘কোনো এলাকায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব শুনলে তোমরা সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। যদি প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে এবং তুমি সেই এলাকায় অবস্থান করো, তা হলে সেই জায়গা থেকে পালিয়ে যেও না’ (সহিহ বুখারি, ৬২৬)। এখানে প্লেগের কথা বলা হলেও এর দ্বারা মহামারীর মতো যেকোনো রোগের প্রাদুর্ভাবকেই বোঝানো হয়েছে। কেননা, প্লেগ সেই জমানায় ছিল একটি বড় প্রাণঘাতী মহামারী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক। রশসড়যড়হ@মসধরষ.পড়স
আগামীকাল : করোনা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা