২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আইয়ুব আ:-এর আমল থেকে শিক্ষা

-

হজরত আইয়ুব আ:-এর পুরো বর্ণনা ও আলোচনায় কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণÑ
১. হজরত আইয়ুব আ:-এর অসুস্থতার ব্যাপারে কুরআনে আর কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি, হাদিসের বিশাল ভাণ্ডারেও এ বিষয়ে আর কিছু জানা যায়নি। তবে পরিস্থিতি বলে, রোগটি অনেক ভয়ানক, ক্ষতিকর আর এটি যে সংক্রমণ জাতীয় ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এর ফলে অসুস্থ ব্যক্তিকে নবীর আ: পবিত্র স্ত্রী ছাড়া সবাই সংক্রমণের ভয়ে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এটাও স্পষ্ট যে রোগের কারণে তাঁকে নির্জন ও নিঃসঙ্গ থাকতে হয়। ইসরাইলি রেওয়ায়েতে আরো অনেক কিছু বলা হয়েছে কিন্ত সেগুলোর ওপর আমরা নির্ভর করতে পারি না।
২.আমরা জানি যে রোগ শোক আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। কিন্তু এখানে তিনি কেন বললেনÑ শয়তান আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টসহকারে স্পর্শ করেছে। মূলত এটিই নবীগণের কথার আদব ও শিষ্টাচার; যা কিছু ভালো তার জন্য নবীগণ মহান আল্লাহর দিকে সেটাকে সম্পৃক্ত করে দেন, অন্য দিকে যখন মন্দ কিছু তাদের স্পর্শ করে তখন সেটিকে তারা নিজেদের দিকে নিক্ষেপ করেন। আমরা করি বিপরীত। অসুস্থ হলে আমরা আল্লাহকে দোষারোপ করি এবং নিজেদেরকে অভিসম্পাত দিতে থাকি।
শয়তানকে দোষারোপ করার আরেকটি কারণ হলো তার এমন কঠিন মুসিবতকালে আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীরা সবাই তাকে ছেড়ে গেলে শয়তান ক্রমাগত তাঁকে দুশ্চিন্তাগস্ত করে তোলে, আল্লাহ সম্পর্কে ভুল বোঝাতে থাকে এবং দুঃখ বিলাপ করতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। এটা আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে।
৩. অসুস্থতার চূড়ান্ত কষ্টে পৌঁছেও তিনি হতাশ হয়ে পড়েননি, তিনি ধৈর্যহারাও হননি। না তিনি সারাক্ষণ উহ আহ করেছিলেন আর না চিৎকার করেছিলেন। এমনকি আল্লাহর কাছে প্রার্থনার আকারে যা বলেছিলেন সেটাও অনের বড় শিক্ষণীয়। তিনি বলতে পারতেন- আল্লাহ আমার কঠিন বিমার হয়েছে, আমার শরীর থেকে পচে পচে গোশত খসে পড়ছে। এক অনিরাময়যোগ্য বিপদগ্রস্ততার শিকার হয়েছি। আমাকে তুমি রক্ষা করো এবং তোমার পক্ষ থেকে শিফা নসিব করো। কমপক্ষে এতটুকু তো বলাই যেত। কিন্তু তিনি কী বললেন? তিনি বললেনÑ আমি দুঃখকষ্টে পড়েছি। আপনি দয়াবানদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। ভাবুন, একজন নবী দীর্ঘ আঠারো বছর কঠিন রোগে শয্যাশায়ী, অথচ আল্লাহকে যখন বলছেন কোনো অভিযোগ নেই, কোনো অনুযোগ নেই, কষ্ট কাতরতা কিছু নেই। কত নরম সুর, কত ইমোশানাল, কনভিনসিং ও শালীন দোয়া।
৪. রোগ যতই কঠিন ও অনিরাময়যোগ্যই হোক, সুস্থতাও আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। মুমিন এ জন্য রোগে শোকে হতাশ হয় না। এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে তাদেরকে নিঃসন্দেহে উদ্ধারও করবেন। আইয়ুব আ:-কেও আল্লাহ সুস্থতা দান করেছেন এবং সেটা ছিল খুবই সাধারণ উপায়ে।
৫. অসুস্থার দরুন আইয়ুব আ:-এর যেসব সন্তানাদি ও আত্মীয়স্বজন চলে গিয়েছিলেন তারা সবাই আবার ফিরে আসেন। আবার পাড়া-পড়শীর আগমনে সব যেন প্রাণ খুঁজে পায়। মৃত পরিবার আবার জেগে উঠে শত কোলাহলে। কোনো কোনো তাফসিরে লিখেছেÑ এমনকি যারা এই আঠারো বছরে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আল্লাহ পাক তাদেরও ফিরিয়ে আনেন এবং প্রত্যেক পরিবারে আরো অধিক সন্তানাদি দান করেন।
৬. আইয়ুব আ:-এর স্ত্রী এমন কঠিন অবস্থায়ও উনাকে ছেড়ে যাননি। স্বামীর অসুস্থতায় তিনিও সমান পেরেশান ছিলেন। এতদসত্ত্বেও কেন তাকে এক শ’ বেত্রাঘাত করা হলো। সুবহানাল্লাহ, আল্লাহর বিজ্ঞতা যে কত বড়, সেটা ভাবার ক্ষমতাও আমাদের নেই। ঘটনাটি হলোÑ পূর্বেই বলেছি শয়তান খোদ নবী আ: ও তাঁর স্ত্রীকে এমন কঠিন অবস্থায় নানাভাবে কুমন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছিল। নবী হওয়ার কারণে আইয়ুব আ: তা আমলে নেননি, কিন্তু তার পেরেশান স্ত্রী কোমল মনে সরল বিশ্বাসে শয়তানকে একপর্যায়ে বিশ্বস্তভাবে। এতে আইয়ুব আ: রাগ করেন এবং রাগের বশে শপথ করে বসেন যে, সুস্থ হলে তিনি তাকে এক শ’ বেত্রাঘাত করবেন। এটি ছিল স্বামীসুলভ শাসন। এখন তো সেই শপথ বাস্তবায়নের সময় এসেছে। মুফাসসিরিনগণ লিখেন যে, এক দিকে নিঃসঙ্গ সময়ে স্ত্রীর নিরলস সেবা, তার অবিরাম পেরেশানি ও অতুলনীয় বিশ্বস্ততা এবং বিপরীতে শপথ পরিপালন আইয়ুব আ:-কে দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেয়। তখন আল্লাহ তাকে এক শ’টি তৃণখণ্ডকে একজোট করে একবারের জন্য স্পর্শ করতে আদেশ দেন, যাতে তিনি আঘাতও না পান আবার শপথও রক্ষা পায়। স্ত্রীগণের প্রতি স্বামীদের শাসন থাকবে তবে তা কতটুকু কী হবে এখানে তার নির্দেশনা আছে।
৭. সবশেষে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আমি তাকে অর্থাৎ আইয়ুব আ:-কে ধৈর্যশীল পেয়েছি। তিনি এত বড় একটি পরীক্ষা ঈমানের পরাকাষ্ঠায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হলেন। আল্লাহ আরো বলেন- অতি উত্তম বান্দা সে। নিশ্চয়ই সে অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী। সুতরাং এমন সার্টিফিকেট আল্লাহর কাছ থেকে দুনিয়াতে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
আল্লাহ আমাদের হেদায়াত দিন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকার ও গ্রন্থকার

 


আরো সংবাদ



premium cement