২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আমলই বলবে কে উত্তম

-

কাউকে যখন এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হয়, তখন সে সত্যিই অসহায়, অপারগ। পৃথিবীর যতই ক্ষমতাধর কেউ হন, এই একটা জায়গায় প্রত্যেকেই বড় বেশি অক্ষম, চাইলেও কিছু করার থাকে না। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীকেই তার এই পার্থিব জীবন সমাপ্তির ক্ষণটিতে গিয়ে পৌঁছতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর কিয়ামতের দিনই তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় প্রদান করা হবে। আর যাকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে দূরে রাখা হবে এবং যে জান্নাতে প্রবেশ করবে, সেই হবে সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগবিলাস ছাড়া আর কিছু নয়।’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত-১৮৫)।
পরিচিত মুখ বা বিখ্যাত কেউ যখন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন বা করতে হয়, তখন তা সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবর হয়ে আসে। সাধারণত মৃত্যুসংবাদে মানুষের মন নরম হয়, মানুষ ব্যথিত হয়, আল্লাহর কাছে দোয়া করে মৃতের জন্য মাগফিরাত (ক্ষমা) চেয়ে। আপন অথবা কাছের কারো মৃত্যুতে কেউ কেউ চূড়ান্ত পরিণামের কঠিন বাস্তবও উপলব্ধি করে নেন। তারা সচেতন হয়ে ওঠেন তাদের ভবিষ্যৎ আসন্ন দিনের কথা ভেবে। যাদের এই অনুধাবনের বোধোদয় ঘটে, তারা মূলত আল্লাহ তায়ালার রহমতের ছায়ায় নিজের জায়গা করে নেয়ার সৌভাগ্যের প্রথম সোপানে পা রাখতে সক্ষম হন।
বর্তমানে কোনো কোনো মানুষের মৃত্যুতে সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে ‘হায় হায়’ রব ওঠে; কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেই হাহাকার কান্নার কারণ ভালো কিছু হারানোর জন্য হয় না, বরং সেটা যেন এক মায়াকান্না। কান্না তখনই মায়াকান্না হয়ে যায়, যখন এতে থাকে বিভ্রান্তিকর কিছু বিষয়। যেমনÑ অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ। অর্থাৎ সেই হাহাকার বেদনাবোধ আসলে নিজেকে প্রদর্শন করে এবং নিজের অনুভূতি অন্যদের কাছে তুলে ধরে নিজে ভেতরের অসুস্থ আত্মাকে আনন্দ দেয়া। এমনও দেখা যায়, মৃত মানুষের সাথে সেলফি অথবা কবর খুঁড়তে গিয়ে সেলফি তুলে আপলোড দেয়া। একজন মানুষ কতটা অমানবিক এবং বিভ্রান্ত হলে এমন কাজ করতে পারে!
আমরা সবাই অসহায় ও অস্থায়ী। প্রতিদিন কেউ না কেউ অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিয়ে এই কথাটাই আমাদের জানান দিয়ে যাচ্ছে। প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে কুরআন মজিদের সেই কথাগুলোরÑ ‘এই দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ তায়ালার কাছেই রয়েছে আসল প্রাপ্তি। একদিন মানুষকে এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার রবের ইবাদতের জন্য। মানুষকে পরীক্ষা করা হবেÑ কে বেশি তাকওয়া অবলম্বনকারী।’ স্বয়ং স্রষ্টার কাছ থেকে এত সতর্কবাণী পেয়েও আমরা কানে তুলা গুঁজে, চোখে রঙিন কাচ লাগিয়ে আত্মপ্রতারণা করে চলেছি। অর্থাৎ খেল-তামাশায় ঢাকা এই পৃথিবীতে আসার অর্থ হচ্ছে, একটা পরীক্ষাকেন্দ্রে আসা, পরীক্ষায় অংশ নেয়া; এটা জেনেও আমরা তাতে গাফেল হয়ে পড়ে আছি। ভুলে আছি, আমাদের চলে যেতে হবে এবং বাহন হয়ে সাহায্য করবে আমাদের ভালো কর্ম এবং আল্লাহ তায়ালার রহমত।
এই পৃথিবীতে কে কত বেশি নামীদামি লোক, কত লোক কাকে কত বেশি সম্মান করে, কার জানাজায় কত বেশি লোক জমায়েত হয়েছে অথবা কাকে কত বেশি লোক ভালো বলে ভোট দেবে তার ওপর কারো সত্যিকারের ভালো নির্ভর করে না; বরং তা নির্ভর করবে তার নিয়ত, তার প্রচেষ্টা এবং তার তাকওয়ার ওপর। সেদিন তার নিজের অঙ্গগুলোই তার কৃত কাজগুলোর সাক্ষীর জন্য যথেষ্ট হবে। সেই ভয়াবহ দিনে ‘কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে তা সে দেখতে পাবে, আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দকাজ করে থাকলে তাও সে দেখতে পাবে।’ (সূরা আল জিলজাল, আয়াত : ৭-৮)। এটা মহান আল্লাহ বান্দাদের তা জানিয়ে দিয়েছেন। আবার যেমনটা বলেছেন সূরা আল মুজাদালাহ (আয়াত : ৬)-তে ‘যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করে উঠাবেন, অতঃপর তারা যে আমল করেছিল তা তাদের জানিয়ে দেবেন। আল্লাহ তা হিসাব করে রেখেছেন, যদিও তারা তা ভুলে গেছে। আর আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী।’ চূড়ান্ত সেই বিচার দিনে মানুষের আমলই বলে দেবে কে উত্তম আর কে অধম। জীর্ণশীর্ণ গরিব ময়লা পোশাকের লোকটাও সেদিন তার সহজ হিসাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি পেয়ে হতে পারে সৌভাগ্যবান, উচ্চ মর্যাদায় সম্মানিত, যাকে আজ আমি-আপনি অবহেলা ও তুচ্ছ চোখে দেখছি। আর যাকে ক্ষমতাবান ও সম্পদশালী দেখে সমীহ করছি, বন্ধুত্ব করে ভালোবাসছি, তার সব কাজে সমর্থন করছি; কিয়ামত দিবসে সে হতে পারে নিঃস্ব ও লাঞ্ছিত। সেই দিন দুনিয়ায় মর্যাদাহীন মানুষকে অবহেলা করার জন্য এবং ক্ষমতাবান সম্পদশালীকে ভালোবাসার কারণে অনুশোচনা হতে পারে আমার-আপনার । কাজেই একজন জ্ঞানী, ধার্মিক, বুদ্ধিমান হিসেবে মানুষের মূল্যায়ন করা উচিত তার সততা, তার দ্বীনদারিতার ভিত্তিতে, সামাজিক বা আর্থিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে নয়। তেমনি কারো মৃত্যুতে লোক দেখানো মায়া নয়, কারো মৃত্যুতে সেøাগান তুলে শোককে হাতিয়ার বানানোও নয়; বরং দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে যাওয়া কঠিন সময়ের মুখোমুখি মানুষটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত এবং পাশাপাশি নিজের জন্য অপেক্ষারত ক্ষণটির কথাও স্মরণ করে ক্ষমা চাওয়া উচিত। একমাত্র আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মেনেই আমরা সচেষ্ট হতে পারি উত্তম কিছু নিয়ে যেতে চূড়ান্ত সেই যাত্রায়, পেতে পারি তাঁর রহমত।
লেখক : প্রবাসী, লস অ্যাঞ্জেলেস; ইউএসএ


আরো সংবাদ



premium cement