২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সাহাবিদের রোজা

-

মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনাচরণ ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন ও আমল-আকিদাই আমাদের অনুকরণ ও অনুসরণ করা উচিত। সাহাবায়ে কেরামরা কিভাবে সিয়াম সাধনা করেছেনÑ তা আমাদের জানতে ও মানতে হবে ঈমান নিয়ে বাঁচতে হলে।
সফরে থাকাবস্থায় রোজা রাখার ব্যাপারে ছাড় থাকলেও প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘ সফরে এবং যুদ্ধের মতো সঙ্কটময় মুহূর্তেও সাহাবায়ে কেরাম রোজা ছাড়তেন না। যেমন আবু বকর রা:-এর যুগে ইয়ামামার যুদ্ধে এক সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাখরামাহ রা: সিয়াম অবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তাঁকে দেখে সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: তাঁর কাছে এলেন। তখন জখমে জর্জরিত ও পিপাসায় কাতর ইবনে মাখরামাহ রা: তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এমতাবস্থায় সিয়াম ভাঙা যাবে কি না? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন ইবনে মাখরামাহ রা: বললেন, তাহলে ভাই! পিয়ালায় করে একটু পানি এনে দাও। ইবনে ওমর রা: গেলেন এবং একটি হাউজ থেকে পানি চামড়ার মশকে ভরলেন। অতঃপর পানি নিয়ে তিনি যখন এলেন, তখন ইবনে মাখরামাহ রা: শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন (তারিখে বুখারি, ইসা-বাহ- তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬৬)।
আর এক সাহাবি ইবনে আবু হাইয়্যাহ আহমাসি রা: একদিন রোজা রেখে যুদ্ধের মাঠে লড়াই করছিলেন। লড়াই করতে করতে তিনি আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়লেন। তাঁর সঙ্গীরা তাকে নিজেদের জায়গায় নিয়ে এলেন। অতঃপর তাঁরা তাঁকে পানি পান করতে দিলেন, কিন্তু রোজা ভেঙে যাবে বলে তিনি তা পান করলেন না। কিছুক্ষণ পর তিনি ইন্তেকাল করে চলে গেলেন তাঁরই কাছে, যাঁর জন্য তিনি রোজা রেখেছিলেন (ইসা-বাহ ফি মারি ফাতিস সাহা-বাহ)।
ওমর রা: যখন তাঁর শহীদ হওয়ার খবর শুনলেন, তখন বললেনÑ তিনি দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাতকে ক্রয় করে নিয়েছেন।
হায়! আমার ভোজনবিলাসী ও রোজা ত্যাগকারী ভাইয়েরা এখান থেকে কোনো শিক্ষা নেবেন কি? মজুদদার, জুলুমবাজ ও অবৈধ পথে রোজগারকারী আপনাদের ত্যাগ, ধৈর্য, সাম্য, সংযম ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের এ মাসে কোনো সুমতি হবে কি?
বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ হাফেজ ইমাম যাহাবি র. বলেন, যে ব্যক্তি বিনা অসুখে রমজানের সিয়াম ছেড়ে দেয়, তার ইসলাম সম্পর্কে বরং সন্দেহ আছে। লোকেরা তাকে জিনদিক মনে করে (ফিকহুস সুন্নাহ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৩৪)।
মহানবী সা: বলেন, আমার উম্মতকে রমজান মাসে পাঁচটি জিনিস দান করা হয়েছে, যা আমার আগে কোনো নবীকেই দান করা হয়নি। প্রথম এই যে, রমজান মাসের প্রথম রাত যখন আসে তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। আর যার ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়ে তাকে তিনি কখনো শাস্তি দেবেন না। দ্বিতীয় হলো, তাদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের সুবাসের চেয়ে সুগন্ধ। তৃতীয় হলো, ফেরেশতারা তাদের জন্য প্রত্যেক দিন ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। চতুর্থ হলো, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা জান্নাতকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি আমার বান্দাদের জন্য তৈরি হও এবং সজ্জিত হও। অতি শিগগিরই তারা দুনিয়ার ক্লান্তি থেকে আমার ঘরে ও আমার সম্মানে স্বস্তি চাইবে। পঞ্চম হলো, যখন শেষ রাত আসে তখন তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। একজন সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি শবেকদরের রাত? তিনি বললেন, না। তুমি কি মজদুরদের দেখনি যে, তারা যখন কাজ থেকে অবসর পায় তখন তাদের মজুরি পুরোপুরি প্রদান করা হয় (বাইহাকির শুআবুল ঈমান কানযুল উমমাল পৃষ্ঠা-৩০২)।
আবু সাঈদ খুদরি রা: বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে (রমজানের) প্রত্যেক দিনে ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দেয়া অনেক দাস রয়েছে। ওর প্রত্যেক দিন ও রাতে প্রত্যহ মুসলিমের জন্য কবুলযোগ্য একটি দোয়া অবশ্যই রয়েছে। (মুসনাদে বাযযার, সহিহুত তারগিব, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৯১, হাদিস নম্বর-৯৮৮)।
বর্জনকারীরাও কাফিরে পরিণত হয়। ওই দুই নির্দেশ লঙ্ঘনকারীর হুকুমের বিষয় বিনা ব্যবধানে একই। সালাত দিন ও রাতের কর্তব্য, যা প্রতিদিনে পাঁচবার এবং সিয়াম বাৎসরিক কর্তব্য, যা সারা বছরের মাত্র একবার অপরিহার্য (বাযলুল মানফাআহ, পৃষ্ঠা-৭৮)।
আবু উমামাহ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম, একটি সম্প্রদায় উল্টোভাবে ঝুলছে। তাদের কপাল ফাড়া। তা থেকে রক্ত ঝরছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? বলা হয়Ñ এরা হলো রমজান মাসে বিনা ওজরে যারা সিয়াম রাখে না’ (সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৭, ইবনে হিব্বান, বাশারাতুল ফোসসাক পৃষ্ঠা-৩৭)।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘বিনা ওজরে রমজানের সিয়াম ত্যাগকারী অবিশ্বাসীরূপে পরিগণিত’ (ফিকহুস সুন্নাহ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৩৪)। যে ব্যক্তি শরিয়তি ওজর ছাড়া এ মাসের একটি রোজাও ছেড়ে দেবে, সে যদি সারা জীবনও সিয়াম পালন করে; তবুও তার পাপের খেসারত হবে না’ (বুখারি)।
উল্লিখিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রোজার তাৎপর্য বা গুরুত্ব অনেক। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমাদের জন্যই এক মাসব্যাপী রোজা ফরজ করা হয়েছে। রমজান মাসের প্রতিটি ফরজ অন্য যেকোনো মাসের ৭০টি ফরজের সমান। রোজা আমাদের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সুসংবাদ নিয়ে হাজির। আমরা যেন, রোজার হক যথাযথভাবে আদায় করতে পারি এ কামনাই করি।
লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement