২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

যুগে যুগে রোজা

-

সিয়াম হলো প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সক্ষম মুসলিম নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাধ্যতামূলকভাবে পানাহার ও যৌন সম্ভোগ এবং অশ্লীল, গর্হিত প্রভৃতি কাজকর্ম, কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা। (ফাতহুল বারি)
আল্লামা যুরকানি বলেন, ‘নিয়তের সাথে সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে দূরে থাকাকে রোজা বলে।’
মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর।’ (সূরা বাকারাহ, ১৮৩) রোজা শুধু উম্মতে মুহাম্মাদীর ওপর ফরজ নয়, বরং পূর্ববর্তীদের ওপরও ফরজ ছিল। এর দ্বারা হজরত আদম (আ:) থেকে হজরত ঈসা (আ:) পর্যন্ত সব উম্মত ও শরিয়তকে বোঝানো হয়েছে। তবে রোজার সময়সীমা, সংখ্যা এবং কখন রোজা রাখতে হবে এসব ব্যাপারে পার্থক্য রয়েছে।
হজরত আদম (আ:) পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও নবী। তাঁর ওপরেও রোজার বিধান ছিল। তাঁর ওপর প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা ফরজ ছিল। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদকে (রা:) আইয়ামে বিজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আদমকে (আ:) এক প্রকার ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি আদেশ অমান্য করে ফলটি খেয়ে ফেলেন। ফলে আদম (আ:) জান্নাত হতে বহিষ্কার হয়ে দুনিয়ায় প্রেরিত হতে বাধ্য হন। সে সময় তাঁর দেহের রঙ কালো বর্ণ ধারণ করে। আদম (আ:)-এর দুর্দশা দেখে ফেরেশতারা কেঁদে ফেলেন এবং আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আদম তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তুমি তাঁকে জান্নাতে স্থান দিয়েছিলে, আমাদের দ্বারা সিজদাও করিয়েছিলে, আর মাত্র একটি ভুলের কারণে তাঁর গায়ের রঙ কালো বর্ণ করে দিলে।
তাদের জবাবে আল্লাহ তায়ালা আদমের (আ:) কাছে ওহি পাঠালেন, ‘তুমি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা পালন কর। এ জন্যই এ তিনটি দিনকে আইয়ামে বিজ বা উজ্জ্বল দিন বলে।’ এ বর্ণনার পেছনে তেমন কোনো যুক্তি নেই। তবে রাসূল সা: বাড়িতে অবস্থানকালে বা সফরকালে অবশ্যই আইয়ামে বিজের রোজা রাখতেন।
আইয়ামে বিজের রোজা সম্পর্কে আবু জর (রা:) বলেন, ‘রাসূল (সা:) একদা আমাকে বললেন, হে আবু জর, তুমি যখন মাসের তিন দিন রোজা রাখবে তখন মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা রাখবে।’ (তিরমিজি, নাসায়ি)
আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, ‘আমার বন্ধু নবী সা: আমাকে তিনটি বিষয়ের অসিয়ত করেছেন, প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখা, চাশতের ২ রাকাত নামাজ পড়া এবং আমি যেন নিদ্রা যাওয়ার আগে বেতের নামাজ আদায় করে নিই।’ (বুখারি শরিফ)
ইবন আব্বাস (রা:) বলেন, ‘নবীজি সা: সফরে ও বাড়িতে আইয়ামে বিজের রোজা রাখতেন।’ (নাসায়ি, মিশকাত-১৮০ পৃ:)
হজরত নূহ (আ:) আল্লাহ তায়ালার একজন দীর্ঘজীবী নবী ও প্রথম রাসূল। তাঁর সময়েও রোজার প্রচলন ছিল। ‘নূহ (আ:) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ছাড়া পুরো বছর রোজা রাখতেন।’ (ইবন মাজাহ) হজরত মুয়াজ, ইবন মাসউদ, ইবন আব্বাস (রা:), আতা, কতাদাহ ও জাহহাক (র:) থেকে বর্ণিত যে, হজরত নূহের (আ:) যুগ থেকে শেষ নবী পর্যন্ত প্রতি মাসে তিনটি রোজার প্রচলন ছিল। পরে তা আল্লাহ তায়ালা রমজানের রোজা দিয়ে তা রহিত করে দেন।’
‘হজরত ইব্রাহিমের (আ:) সময়ে প্রতি মাসে তিনটি রোজার প্রচলন ছিল। কারণ তিনি ছিলেন নূহের (আ:) পরের নবী।’
হজরত মুসা (আ:) একজন নবী ও রাসূল। তাঁর সময়েও রোজার প্রচলন ছিল। ইবন আব্বাস (রা:) বলেন, ‘নবী সা: মদিনায় (হিজরত করে) এসে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটি কী ধরনের রোজা? তারা জবাব দিলো, এটি একটি পবিত্র দিন। এ দিন আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলকে দুশমন থেকে নাজাত দান করেন। তাই এ দিন মুসা (আ:) রোজা রেখেছেন। নবী সা: বললেন, তোমাদের চেয়ে মুসার বেশি হকদার আমিই। অতঃপর তিনিও রোজা রাখলেন এবং এ দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত) মহররম বা আশুরার দিন দু’টি রোজা রাখতে হবে। ৯ ও ১০ মহররম বা ১০ ও ১১ মহররম। ৯ ও ১০ রাখা উত্তম। তবে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে এ মুক্তির দিনে রোজা পালনের উল্লেখ নেই, বরং সেখানে উল্লেখ রয়েছে উৎসব পালনের কথা; রোজার বিপরীতে পানাহারের কথা। ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ‘পুরনো নিয়ম’ এর যাত্রা পুস্তকে (ঊীড়ফঁং-এ) এ দিনে ইহুদিদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
ইহুদিদের মুক্তি দিবসের কর্তব্য সম্পর্কে সহিহ হাদিস ও ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্য পরস্পর বিপরীতমুখী বলে মনে হয়।
গভীরভাবে চিন্তা করলে উভয় তথ্যের মধ্যে কোনো মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয় না। মদিনার ইহুদিরা যে রোজা পালন করত তা ছিল উৎসবকে আরো উৎসবমুখর করে তোলার একটি সহায়ক প্রস্তুতি। রোজা বা উপবাস, ভোজনের উৎসবকে আরো আকর্ষণীয় ও বেগবান করে তোলে নিঃসন্দেহে। আনন্দ-উৎসব ও সাজসজ্জার মধ্য দিয়েই ইহুদিরা যে এ মুক্তি দিবস পালন করত, অন্য হাদিসে তার স্পষ্ট প্রমাণ মিলে। আবু মুসা আশয়ারি (রা:) বলেন, খায়বারের ইহুদিরা আশুরাকে ঈদের দিনের মতো মনে করত। (বুখারি)
হজরত দাউদ (আ:) একজন নবী ও রাসূল। তাঁর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল (আল্লাহর কাছে তাঁর রোজা ছিল উত্তম রোজা)। হজরত রাসূল সা: বলেন, ‘তুমি (আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস) শ্রেষ্ঠ রোজা রাখবে। তাহলো দাউদের (আ:) রোজা। এক দিন রোজা রাখবে আর এক দিন রোজা রাখবে না।’ (সিহাহ সিত্তা, মিশকাত)
ওল্ড টেস্টামেন্টে দাউদের (আ:) যে জীবনবৃত্তান্ত পেশ করা হয়েছে তার পরতে পরতে রয়েছে, তাঁর রোজা পালনের ঘটনাবহুল প্রেক্ষাপট। ইসরাইল নেতা ‘শৌল’ এর মৃত্যুতে দাউদ (আ:) ও তার সঙ্গীরা তাঁর বিষয়ে শোক ও বিলাপ এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস করলেন।
হজরত ঈসা (আ:) ছিলেন একজন নবী ও রাসূল। তাঁর সময়েও রোজার প্রচলন ছিল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আপনি (মারিয়াম) আহার করুন ও পান করুন এবং চক্ষু জুড়ান। অনন্তর আপনি লোকদের মধ্যে কাউকে দেখলে (ইশারায়) বলেন, আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে রোজা মানত করেছি। অতএব আজ আমি কার সাথে কথা বলব না।’ (মারিয়াম, ২৬)
(হে মারিয়াম) ঈসাকে দেখলে লোকে তোমার সতীত্বের প্রতি সন্দেহ করে বিভিন্ন প্রশ্ন করবে। তখন তুমি ইশারায় জানাও আমি রোজা মানত করেছি, আমার কথা বলা নিষিদ্ধ।
সব ফুকাহর মতে, উম্মতে মুহাম্মাদীর ওপর রোজা দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে ফরজ হয়েছে। রাসূলের সা: হিজরতের অষ্টাদশ মাসে কিবলা পরিবর্তনের সময় রোজা ফরজ হয়। উল্লেখ্য, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এগুলোর অপরিহার্যতা রহিত হয়ে গেছে। তবে এসবের সুন্নত বহাল রয়েছে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক ও প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement