২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নবী বংশের মর্যাদা

-


‘নূরুল আবসার’ গ্রন্থে লিখিত রয়েছে, হজরত ইমাম হোসাইন রা:-এর নাতি হজরত আবদুল্লাহ র: কোনো কাজে সমকালীন খলিফা হজরত উমর ইবন আবদুল আজিজ র:-এর কাছে গেলেন। তখন খলিফা তার কাছে বিনীতভাবে বললেন, আপনাদের যখনই যেকোনো কাজ প্রয়োজন হোক, মেহেরবানি করে একটু কাগজে লিখে পাঠিয়ে দেবেন। আমি আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর কাছে নিজেকে অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করি যে, আপনাদের কোনো প্রয়োজনে, আপনারা কেউ আমার কাছে আসতে বাধ্য হবেন! অথচ আমাদের দায়িত্ব আপনাদের কাছে গিয়ে সেবা পৌঁছে দেয়া।
‘মাদারিজ’ নামক গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘ইমাম মালেক ইবনে আনাস র:কে যখন আব্বাসি খলিফার নির্দেশে কোড়া মারা হলো, তখন তিনি সম্বিত ফিরে পেয়ে তাৎক্ষণিক বললেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা সাক্ষী থাকবে, আমি এ জুুলুম ক্ষমা করে দিলাম। কারণ আমার লজ্জা হচ্ছে যে, হাশরের ময়দানে আমার কারণে প্রিয় নবী সা:-এর চাচার বংশধরদের কেউ যেন জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় আটকা পড়ে না যায়!’
‘তারিখুল খুলাফা’ ও ‘সিরাতুল আম্মান’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘হজরত ইমাম আবু হানিফা র:কে আব্বাসি খলিফা মনসুর শুধু এ কারণে জেলে বন্দী করে বিষ প্রয়োগ করেছিল যে, তিনি সৈয়দ মুহাম্মদ নফস জকিয়্যা হাসানি র:-এর ক্ষেত্রে, তার ‘আহলে-বায়ত’ হওয়া বিবেচনায়, আব্বাসিদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া দিয়েছিলেন। তারপর সাহায্যস্বরূপ তার জন্য চার হাজার দিনার পাঠিয়ে লিখে দিয়েছিলেন, আমার দায়িত্বে যদি কিছু লোকজনের ফেরতযোগ্য আমানতের বোঝা না থাকত, তা হলে এ বৃদ্ধ বয়সের দুর্বল অবস্থা সত্ত্বেও আমি শহীদ হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করতাম। ওইসময় তার বয়স ছিল প্রায় ৮০ বছরের কাছাকাছি। সৈয়দ সুলাইমান নদভী র: ‘হায়াতে মালেক’ জীবনীগ্রন্থে লিখেছেন, হজরত ইমাম মালেক র:ও একই ফতোয়া দিয়েছিলেন। এ ছাড়া, হজরত ইমাম শাফেই র:-এরও ‘আহলে-বায়ত’ এর প্রতি প্রেম-ভালোবাসার অনেক প্রসিদ্ধ ঘটনাবলি বিদ্যমান।
হজরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র: ‘আল-মানাকিব’ গ্রন্থে আহলে-বায়তের সম্মান ও মর্যাদা বিষয়ে অনেকগুলো হাদিস বর্ণনা করেছেন। ‘সাওয়েকে মুহাররাকা’ গ্রন্থে রয়েছে, ‘হজরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র: কোনো সৈয়দ বংশীয় শিশুকে দেখলেও, তাৎক্ষণিক সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যেতেন।’
হজরত শায়খ আকবর মহিউদ্দীন ইবনে আরাবি র: ‘ফাতুহাতে মাক্কিয়া’ গ্রন্থে ‘আহলে-বায়ত’ এর শানে অবতীর্ণ ‘তাত্বহির’ সংক্রান্ত আয়াতটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেন, ‘সব সৈয়দ হজরত ফাতেমা রা:-এর বংশধরগণ, মুমিন জননীগণ ও হজরত সালমান ফারসি রা:-এর অনুরূপ অন্যান্য লোকজনকেও, যাদের ‘আহলে-বায়ত’ এর মধ্যে গণ্য করা হয়। তারা সবাই ‘পবিত্রতা’ বিষয়ক আয়াতটির দাবি মোতাবেক মাগফিরাতের নির্দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তারা নিজেরাও পবিত্র এবং তারা অন্যদেরও পবিত্রকারী হিসেবে স্বীকৃত। এটি মহান আল্লাহর সেই বিশেষ অবদানের ফল যা তিনি নবী করিম সা:-এর পরিবারস্থদের জন্য বরাদ্দ করেছেন। কোনো মুসলমানের পক্ষে মোটেও শোভনীয় নয়, তাদের কারো কোনোরূপ সমালোচনা করাÑ যাদের পবিত্রতা ও সবরকম অশোভনীয় আচরণমুক্তি বিষয়ে খোদ মহান আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ মর্যাদা ও অবদান তাদের কোনো নেক আমলের ফল নয়; বরং তা শুধু তাদের বংশের সম্মানার্থে, যা মহান আল্লাহর বিশেষ দান। আর মহান আল্লাহ যাকে চান তাঁর বিশেষ আনুকূল্য দিয়ে থাকেন।
৬ . ইমাম আবদুল ওয়াহাব শারানি র: ‘লাতায়েফুল-মিনান’ গ্রন্থে হজরত শায়খ আকবার র:-এর ‘আহলে-বায়ত’গণের মর্যাদা বিষয়ক দু’টি পঙক্তি উদ্ধৃত করছেনÑ
‘নবী করিম সা:-এর ‘আহলে বায়ত’ এর সমান আর কাউকে মনে করবে না। ‘আহলে-বায়ত’গণই সৈয়দ বংশের অন্তর্গত, নেতৃত্বের অধিকারী। তাদের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ মানুষের ধ্বংসের প্রকৃত কারণ। আর তাদের প্রেম-ভালোবাসাই ‘বড় ইবাদত’ বলে পরিগণিত।’
তারপর তিনি লিখেন, আমার প্রতি মহান আল্লাহর অনেক বড় অনুগ্রহ যে, আমি নবী-বংশের ও রাসূল সা:-এর সন্তানদের প্রতি আদব ও সম্মান প্রদর্শনকে অবশ্যকরণীয় বলে মনে করি; তাদের ব্যক্তিগত আমল যেমনই হোক না কেন। কেননা, কারো আমলে ত্রুটির কারণে তার বংশীয় সম্মান হ্রাস পায় না।
৭. হজরত শাহ শরফুদ্দিন বু আলী কলন্দর পানিপত্তি র: সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, লিখা হয়ে থাকে যে, তিনি সৈয়দ বংশীয় একজন বিধবা নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে ওই নারীর সমর্থনে সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজির কাছে নিম্নোক্ত চতুর্পদি আরবি কবিতাটি লিখে পাঠিয়েছিলেনÑ
যার অর্থ- ‘সৈয়দ বংশীয়গণ সর্বশ্রেষ্ঠ! এবং শ্রেষ্ঠ ছিলেন! তাদের সম্মান-মর্যাদা দিবালোকের চেয়েও উজ্জ্বল। তারা হচ্ছেন হজরত আলী রা: এবং রাসূল সা:-এর কলিজার টুকরো মা ফাতেমা রা:-এর বংশধর। হে বেখবর! তাদের কর্মকাণ্ড বিষয়ে সমালোচনার দৃষ্টি পরিহার করো! নেক-ভালো যা হয় সব আল্লাহর দান! আর মন্দ-খারাপ যা আছে সব আমাদেরই কৃতকর্মের ফল।’
৮. একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে গেঁথে রাখতে হবে যে, সর্ব সাধারণকে নবী-বংশের আদব-সম্মান বিষয়ে সর্বোচ্চ লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা থাকা, প্রিয়নবী সা:-এর প্রতি প্রেম-ভালোবাসারই একটা অংশ ও শাখাতুল্য। এটি মনে-প্রাণে বুঝে নিতে হবে। তাদের হাদিয়া-সম্মানী, উপহার প্রদান, তাদের অন্যান্য প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখা নিজ দায়িত্ব বলে মনে রাখতে হবে। এটা হচ্ছে নবী-বংশের প্রতি আদব-সম্মানের একটি চিত্র। এ চিত্রের আরেকটি দিক হচ্ছে, যারা সৈয়দ বংশীয় তথা নবী-বংশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবেন তাদের অবশ্যই পাপাচারিতা, অন্যায়-অপকর্ম থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তাদের মহানবী সা:-এর সঙ্গে নৈকট্য ও আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়ে থাকে। যে কারণে তাদের কারো শরিয়তের বিধিবিধানের খেলাপ আচরণ মহানবী সা:-এর কষ্টের কারণ হয়ে থাকে। তারা এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে মহানবী সা:কে হাশরের দিন মুখ দেখাবে? প্রিয় নবী সা: যদি এমনটি বলে দেন যে, সাধারণ জনগণ তো আমার সুন্নত ও আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেই! অথচ তোমরা তো আমার আপনজন ছিলে, তোমরা কেন আমার আদর্শ থেকে দূরে সরে গেলে? তা হলে চিন্তা করুন, সে ক্ষেত্রে বিষয়টি কত লজ্জাজনক হবে? দুনিয়াতে দু-চারজন মানুষ যদি সম্মান ও আদব প্রদর্শন করেও থাকে; কিন্তু পরকালে যদি আল্লাহ তায়ালার রাসূলের সামনে সম্মান না পাওয়া যায়; তা হলে এ সম্মানের কী মূল্য আছে? মহান আল্লাহ আমাদের পরকালের অপমান-অসম্মান থেকে হিফাজত করুন!
লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

 


আরো সংবাদ



premium cement