আল্লাহ ব্যতীত কোনো উদ্ধারকারী নেই
- মোহাম্মদ আবদুল হাই
- ১২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
পীর শব্দটি ফারসি। যার অর্থ হলো বৃদ্ধ ব্যক্তি। অনেকে পীরের অর্থ করেন ওস্তাদ। ওস্তাদ আরবি শব্দ। ওস্তাদ বলতে আমরা সাধারণত শিক্ষক মনে করি। তাহলে পীরপন্থীরা তাদের শিক্ষককে ওস্তাদ না বলে পীর বলে কেন? পীর বলে কোনো শব্দ কুরআন বা হাদিসে নেই। কাজেই রাসূলুল্লাহ সা:-এর সময় বা সাহাবাদের যুগেও পীর শব্দটির কোনো ব্যবহার আরব সমাজে ছিল না। এখনো আরব দেশে কোনো পীর পাওয়া যায় না। পীর শব্দের উৎপত্তি হয়েছে পারস্য থেকে। বড়পীর বলে পরিচিত আবদুল কাদের জিলানির জন্ম হয়েছিল পারস্যের জিলান শহরে। তিনি নিজেকে কখনো বড়পীর বলে দাবি করেননি। তার মৃত্যুর পর তার অতি উৎসাহী ভক্তরা আবদুল কাদের জিলানি সম্পর্কে বহু মুখরোচক কল্পকাহিনী তৈরি করেছেন। আল কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ ভক্তরা পীরকে আল্লাহর সমকক্ষ তৈরি করে শিরকে লিপ্ত হয়েছেন।
অনেকে আবার পীর শব্দকে কুরআনে ব্যবহৃত অলি শব্দের সমার্থক মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে পীর শব্দের পরিবর্তে কুরআন ব্যবহৃত অলি শব্দ যথার্থ হতে পারে না।
ভারত উপমহাদেশ পীরদের জন্য অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত। এ দেশের বেশির ভাগই পীরই ভণ্ড। কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ মুসলিম সমাজে তারা অবাধে ধর্ম নিয়ে ব্যবসায় করে থাকেন। মুরিদদের কাছে থেকে ধন সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে তুলতে তাদের কোনো বাধা নেই। তাদের পেশাই হলো মুরিদদের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন। তবে কোনো পীর যদি মুরিদদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি না করে কুরআন-হাদিস অনুযায়ী ফায়সালা দেন তবে তাকে ওস্তাদ হিসেবে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। অনেক পীর আবার জিন আশ্রয়ী। বিভ্রান্ত জিনদের সাহায্যে কেরামতি দেখিয়ে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের বিভ্রান্ত করে। পীরতন্ত্রকে যারা পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে তারা বিভ্রান্ত। কারণ আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘তোমারা আমার আয়াতের পরিবর্তে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করো না।’ (সূরা বাকারা : ৪১) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন, ‘অনুসরণ করো তাদের, যারা তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চায় না এবং যারা সৎপথ প্রাপ্ত।’ (সূরা ইয়াসিন : ২১) এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো আর তার ওপর আমল করো তার দ্বারা খাওয়া পরার ব্যবস্থা করো না।’ (সহিহ আহমেদ) অথচ পীররা শূন্য পকেটে বের হয় আর পকেট ভর্তি করে বাড়ি ফিরে। এরা আল্লাহ এবং রাসূল সা:-এর কথা অমান্য করে আয়াত বিক্রি করে হারাম পথে রোজগার করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ আলেম এবং সংসার বিরাগীদের মধ্যে অনেক লোকের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে থাকে। (সূরা তাওবাহ : ৩৪)
তা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে স্পষ্টভাবে অলি-আউলিয়াদের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। আলোচনার সুবিধার্থে আল কুরআন থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হলো।
সূরা আরাফের ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা অনুসরণ করো যা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং তাকে ছাড়া কোনো আউলিয়াকে অনুসরণ করো না।’
এই আয়াতটিতে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, দ্বীনের জন্য অনুসরণযোগ্য দলিল হলো আল কুরআন, কোনো অলি নয়।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অলি নেই, কোনো সাহায্যকারীও নেই।’ (সূরা শোয়ারা : ৩১)
একই কথার পুনরাবৃত্তি হয়েছে সূরা আনকাবুতের ২২ নম্বর আয়াতে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোনো অলি নেই, সাহায্যকারীও নেই।’
সূরা তাওবার ১১৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত না কোনো অলি আছে আর না কোনো সাহায্যকারী’ সর্বোপরি আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে তাদের অলি আল্লাহ।’ (সূরা বাকারা : ২৫৭)
এরপরও যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে অলি হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ভিন্ন অন্যকে অলি হিসেবে গ্রহণ করেছে, তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়সার ন্যায়। সে ঘর বানায় আর সব ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো অধিক দুর্বল, যদি তারা জানত’ (সূরা আনকাবুত : ৪১) অর্থাৎ অলিদের যারা অনুসরণ করে তাদের স্থায়িত্ব মাকড়সার ঘরের মতো ক্ষণস্থায়ী।’
অলি হিসেবে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের যথার্থ জানেন। আর অলি হিসেবে আল্লাহ যথেষ্ট এবং সাহায্যকারী হিসেবেও আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা নিসা : ৪৫)
কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি কি জানো না যে আল্লাহর জন্যই নভোমণ্ডল এবং ভূমণ্ডলের আধিপত্যে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোনো অলি ও সাহায্যকারী নেই।’ (সূরা বাকারা : ১০৭)
যেহেতু সব ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তায়ালা, কাজেই অভিভাবকও তিনি, সাহায্যকারীও তিনি। পীর, দরবেশ এবং অলিদের যারা অনুসরণ করে তাদের ভুল ধারণা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জেনে রাখো নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহরই নিমিত্ত। যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে এবং বলে যে, আমরা তাদের ইবাদত এ জন্য করি যেন, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। নিশ্চয়ই তাদের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফায়সালা করে দেবেন। আল্লাহ মিথ্যাবাদী কাফিরদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ (সূরা জুমার : ৩)
আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আর কোনো লোক এমন রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালোবাসা পোষণ করে যেমন আল্লাহর প্রতি হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী তাদের ভালোবাসা তাদের তুলনায় বহুগুণে বেশি। আর কতই না উত্তম হতো যদি এ জালিমরা পার্থিব কোনো কোনো আজাব প্রত্যক্ষ করেই উপলব্ধি করে নিত যে, যাবতীয় ক্ষমতা শুধু আল্লাহর জন্য আর আল্লাহর আজাব সবচেয়ে কঠিন।’ (সূরা বাকারা : ১৬৫)
উপরিউক্ত আয়াত দু’টিতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, কিছু লোক আল্লাহ তায়ালাকে পাওয়ার জন্য মাধ্যম খুঁজে বেড়ায় এবং আল্লাহর সমকক্ষ মনে করে তাদেরকে উপাসনা করে। মহানবী সা:-এর আবির্ভাবের আগে আরবের লোকেরা লাত, মান্নাত, উজ্জা, প্রভৃতি দেবদেবীকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করে পূজা করত। সে কারণে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জেনে শোনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিও না।’ (সূরা বাকারা : ২২) আরো ইরশাদ করেন, ‘অবিশ্বাসীরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর উপাসনা করে যা তাদের কোনো উপকার বা অপকার কিছুই করতে পারে না।’ (সূরা হজ : ১২)
কুরআন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ কিছু লোক বর্তমান যুগেও পীর দরবেশদের এমনভাবে ভক্তি করে, যা কেবল আল্লাহরই প্রাপ্য। মুশরিকদের মতোই এরা শিরকে লিপ্ত। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা তাদের আলেম ও দরবেশগণকে আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছে।’
যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সাহায্য আসতে পারে না আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে।’ (সূরা আনফাল : ১০) আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যদি আল্লাহ তোমার কোনো ক্ষতি করাতে চান, তবে তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা দূর করিতে পারে না। (সূরা আনআম : ১৭)
অতএব, পীর, অলি বা দরবেশের কাছ থেকে কোনো সাহায্য আসতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বিশ্বাসীগণকে তার নিকট সাহায্য চাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সূরা বাকারা : ১৫৩)
সে কারণেই আমরা প্রতিনিয়ত সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করি এবং বলি আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ (সূরা ফাতিহা : ৪)
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ছাড়া শুধু রাসূলুল্লাহ সা:-কে অনুসরণ করতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের কর্মফল বিনষ্ট করো না।’ (সূরা মুহাম্মদ : ৩৩) রাসূলুল্লাহকে অনুসরণ করার নির্দেশ আরো বহু আয়াতে রয়েছে। তবে একটি মাত্র আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য করো রাসূলের আর আনুগত্য করো তাদের যারা কর্তৃত্বশীল। (সূরা নিসা : ৫৯) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী না হলে সে কর্তৃত্বশীল হতে পারে না। পীরেরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী নয়। কাজেই তারা উলিল আমর হতে পারে না।
উলিল আমরকে অনুসরণ করতে বললেও আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো তার রাসূলের আর আনুগত্য করো কর্তাব্যক্তিদের। আর যদি তোমাদের মধ্যে মতের মিল না হয়, তাহলে তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরে আস, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক’। (সূরা নিসা : ৫৯)
তা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যদি তোমাদের মতো একজন লোকের আনুগত্য করো তাহলে তোমরা নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সূরা মুমিনুন : ৩৪)
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, কোনো পীর, দরবেশ, আউলিয়াকে অনুসরণ করা যাবে না। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকেই অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী রাসূল সা:-কে অনুসরণ করাও অপরিহার্য। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে রাসূলের আনুগত্য করল সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল।’ (সূরা নিসা : ৮০)
অতএব, পীরদের অনুসরণ করা বা উদ্ধারকারী মনে করার প্রশ্নই উঠে না।
লেখক : সাবেক উপাধ্যক্ষ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা