২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অহঙ্কার পতনের মূল

-

কীর্তিমান দীর্ঘজীবী হোক। তার কৃতিত্বে উল্লসিত হোক জগৎসংসার। বিমোহিত হোক চতুর্পাশ। কিন্তু সাবধান! অহঙ্কার যেন তাকে স্পর্শ করতে না পারে। অনেকেই হয়তো জানেন না, অহঙ্কার পতনের মূল। সুন্দর থেকে সুন্দরতর কীর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। কর্ম ও কীর্তিতে, সৌন্দর্যে মুগ্ধ হোক পৃথিবী, রূপ-ঐশ্বর্যে চমকিত হোক, সুখী হোক বন্ধু-স্বজন। কিন্তু ভুলেও অসুন্দরকে উপহাস করা, অস্বীকার করা ঠিক হবে না। কেননা, তাহলে নিজেই আর বিশিষ্ট থাকা যায় না। অসুন্দর প্রবৃত্তি ও মানসিকতা ঘৃণার, মানুষ নয়।
তুচ্ছ জ্ঞানে কাউকেই আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না, নিরাশ হতে দেয়া যায় না। যাকে পছন্দ করি না, সহ্য করতে পারি না তাকে এড়িয়ে চলা যায়। বিষয়টা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু তার তির ল্েয মতার অপব্যবহার করতে পারি না। তার জীবনসংহার বা ব্যর্থ করে দেয়ার কোনো অধিকার আমাদের কারো নেই। আমরা সভ্যসমাজের শিতি মানুষ, দাবি করি সংস্কৃতিবান। কিন্তু আপন স্বার্থে যখন ঘা লাগে তখন সব কিছুই ভুলে যাই। আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদার কথাও মনে থাকে না। নীচু মনের পরিচয় দিতে দ্বিধা করি না। হয়ে উঠতে পারি ভয়ঙ্কর নৃশংসও। এরকমই হয়, হচ্ছে। প্রতিদিনই এমন সব ঘটনার মুখামুখি হচ্ছি আমরা। কেউ আপন স্বার্থে লাভবান হচ্ছে, কেউ সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত। আর সব দেখেও কিছুই দেখছে না কেউ কেউ। হয়তো বেশির ভাগ মানুষ বুঝতেও পারছে না কোথা থেকে কেমন করে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে গেল।
সন্দেহ, হিংসা ও বিদ্বেষ মানুষের মনের এক ভয়ঙ্কর ব্যাধি। অহংবোধ তাকে অন্ধ করে দেয়। অর্থ-প্রতিপত্তি, মতা, বিদ্যা-বুদ্ধির বড়াই, কৌলিন্যের অহমিকা, বংশগত অহংবোধের কারণে অকারণই মানুষ মানুষকে ছোট করে দেখে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে এরা অপরকে ধ্বংস করে দিতে চায়, দেয়ও।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলোÑ এরা জানেও না, ‘মানুষকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না’। মানুষ নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়ে শেষ হয়ে যেতে পারে কিন্তু তার আত্মসম্মান-আত্মমর্যাধাবোধ তাকে পরাজিত হতে দেয় না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অন্তত করে। প্রবল পরাক্রম দুর্বল অধীনস্থকে পিষে মারতে চাইলেও শেষবারের মতো হলেও মাথা তুলে অন্তত একবার সে আঘাতকারীকে দেখে নেয়ার চেষ্টা করে।
পবিত্র দূত আল্লাহর প্রশংসা করেন, ইবাদতের জন্য একান্ত অনুগত, সমর্পিত এবং আজ্ঞাকারীতো বটেই, তবু সৃষ্টিকর্তা কাদা-মাটির মানুষ সৃষ্টি করলেন এবং প্রমাণ করলেনÑ মানুষই শ্রেষ্ঠ, মেধাবী। পান্তরে আজাজিল যাবতীয় গুণে গুণান্বিত হওয়া সত্ত্বেও অহঙ্কার তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াল। স্বর্গ থেকে তাকে বিতাড়িত হতে হলো।
মতা নেশার মতো। মতাধর মানুষ নেশাখোর, হুঁশহারা হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে বসে। নেশার ঘোরেই কখন যে সে মানুষ হয়েও মানুষের ওপর জুলুম করে বসে, সময় থাকতে কিছুই তার বুঝে আসে না। নিজেই স্রষ্টার অবতার সেজে বসে।
বাঙালি লেখক আবুল ফজল বলেছেন, যেসব জিনিস মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে, তার মধ্যে সেরা হচ্ছে ‘যুক্তি’। আবার হুমায়ুন আহমেদের ‘জোছনা ও জননী’ উপন্যাসে লেখকের পর্যবেণ মতা বলছে, ‘মানুষকে বিবেক দেয়া হয়েছে। চিন্তা করার মতা দেয়া হয়েছে। যুক্তিবিদ্যার মতো কঠিন বিদ্যায় জন্মসূত্রেই মানুষ পরদর্শী। সেই মানুষকে একেবারে গণনার মধ্যে না নেয়া কোনো বুদ্ধির কাজ নিশ্চয়ই নয়।
সময় মানুষকে যে শিা দিতে পারে তা আর কেউ পারে না। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে না পারলে কোনো শাসকই সুশাসক হতে পারেন না। শাসক রাষ্ট্রের অভিভাবক, রক। মতার নেশায় বিভোর, বেহুঁশ হলে শাসিতের বিশ্বাস ও নির্ভরতার যোগ্য থাকতে পারেন না। মুক্তির নেশা ধরা মানুষের সামনে এরা দাঁড়াতেই পারেন না। মুক্তির নেশা আরো বড় নেশা। একবার সে নেশা চড়ে গেলে, রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। যা থাবা দিয়ে নেভানোর কথা কল্পনাও করা যায় না। কিছুতেই না।
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement