২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আশুরার তাৎপর্য

-

অন্যায়-অসত্যের সাথে ন্যায় ও সত্যের ঘাত-প্রতিঘাতের বহু ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত ১০ মহররম বা আশুরা প্রাচীনকাল থেকেই বিশেষ মর্যাদা ও অনন্য সম্মানে ভূষিত। দিগভ্রান্ত মানব সমাজকে সত্য-সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য মহান আল্লাহ যেমন এই দিনে পৃথিবীর বুকে তাঁর অনেক বিশিষ্ট নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, তেমনি ওইসব মহান ব্যক্তিত্বের নীতি-আদর্শের সাথে অন্যায়ভাবে সঙ্ঘাত সৃষ্টিকারী অপরাধপ্রবণ মানুষদের অনেক বড় বড় ঘটনাও ঘটেছে এ দিনেই। আশুরার অন্যান্য ঘটনাসহ এ দিনে কারবালায় সংঘটিত ঘটনা থেকে মুসলিম উম্মাহর নানাভাবে শিা ও প্রেরণা গ্রহণ করা উচিত।
আশুরার অর্থ ও ফজিলত : আশুরার অর্থ চন্দ্র বছরের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ। আশুরার ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে মহানবী সা: বলেছেন, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমে রোজা রাখা’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করছি যে, তিনি বিগত এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন’ (মুসলিম)। উল্লেখ্য, শুধু দশম তারিখের রোজা রাখা বৈধ হলেও নবম ও দশম তারিখের রোজা রাখা সুন্নত। আশুরা ও মহররমকে কেন্দ্র করে একমাত্র রোজা ছাড়া আর অন্য কোনো ইবাদত কুরআন ও সহিহ হাদিসে প্রমাণিত নয়।
আশুরার দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা : আশুরার দিন মানবজাতির ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যেমনÑ এ দিনেই পৃথিবীর সূচনা হয়েছিল এবং এ দিনেই পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। লাওহে মাহফুজ ও কলম সৃষ্টি হয়েছিল এ দিনে। হজরত জিবরাইল আ:সহ অন্যান্য ফেরেশতা পয়দা হয়েছিলেন এ দিনে। এ দিনে বহু নবী জন্মগ্রহণ করেছেন এবং বহু নবীর ফরিয়াদ আল্লাহ কবুল করেছেন। এ দিনে হজরত আদম আ:-এর তওবা কবুল হয় এবং নূহ আ:-এর কিস্তি প্লাবন থেকে মুক্তি পায়। এ দিনেই হজরত ইউনুস আ: মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এবং হজরত আইয়ুব আ: কঠিন ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করেন। এ দিনেই হজরত মূসা আ: ফেরাউনের নির্মম নির্যাতন থেকে নিষ্কৃতি পান এবং হজরত ঈসা আ: আসমানে উত্থিত হন। সর্বোপরি এ দিনে বাতিলের মোকাবেলায় ইমাম হোসাইন রা: কারবালার প্রান্তরে শাহাদতের সুধা পান করে কারো কাছে মাথা অবনত না করার মহান শিা দিয়ে যান।
কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত ঘটনার সংপ্তিসার : শহীদী কারবালার ঘটনাবলির সাথে অনেকাংশেই জড়িয়ে আছে মুসলমানদের ঈমান, আকিদাসহ ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নিপীড়ন ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল কুফার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। খুলাফায়ে রাশেদার পর হজরত মুয়াবিয়া রা: ইসলামী রাষ্ট্রের একচ্ছত্র নেতা হন।
ন্যায় ও শান্তির দিশারি মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রা: অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য, ধর্ম ও ন্যায়কে চির উন্নত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিবার পরিজনসহ নিজ জীবনকে উৎসর্গ করে শাহাদতবরণ করেছিলেন। প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, খেলাফত বনাম ইসলামী গণতন্ত্রের আদর্শ রা করতে গিয়ে রাজতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পথ রুখে সপরিবারে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কেন শাহাদতের কঠিন সুধা পান করেছিলেন?
পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান বিধায় ইসলাম শুধু ব্যক্তির বিশ্বাসেই নয়, কর্মেও সংস্কার চায়। সংস্কার আনতে চায় রাষ্ট্রেও। ফলে একজন প্রকৃত মুসলিম শুধু নিজের নয়, রাষ্ট্রের সংস্কারেও সচেষ্ট হয়। ইসলাম তার অনুসারীদের কাছে প্রত্যাশা করে অন্যান্য সব দ্বীন-ধর্ম ও মতবাদের ওপর বিজয়ী হতে। মিথ্যার স্থলে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে। ইসলাম ধর্ম-কর্মকে নামাজ, রোজা, তাসবিহ-তাহলিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে মার খাওয়া ও দেয়াকে ইবাদতরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী ইমাম হোসাইন রা: ছিলেন শান্তির প্রতীক, তবে সে শান্তি জালিমের প্রবর্তিত শান্তি নয়। তিনি ছিলেন অতীব বিনয়ী, তবে অসত্যের বিরুদ্ধে অতি বিদ্রোহীও বটে। ইসলাম ধর্মের বিধান পূর্ণ বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞার কারণেই ইয়াজিদের সাথে সহাবস্থান সম্ভব হয়নি ইমাম হোসাইন রা:-এর। যেমন সম্ভব হয়নি হজরত ইবরাহিম আ: ও নমরুদ, হজরত মূসা আ: ও ফেরাউন এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ও আবু জাহেল, আবু লাহাবসহ অন্যান্য ধর্মদ্রোহীদের সাথে। সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিল সমন্বয়ী নয়, সঙ্ঘাতই অনিবার্য। এ সঙ্ঘাতের অবর্তমানে সত্যের সত্যতাই সন্দেহযুক্ত হয়। বাতিলপন্থী ইয়াজিদের সাথে সম্প্রীতি এ জন্যই ইমাম হোসাইন রা:-এর কাছে অচিন্তনীয় ছিল, তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন ইয়াজিদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ভূমিকা কী হবে। শাহাদতের মধ্য দিয়ে ইসলামের চেতনাকে তিনি জীবন্ত করে গেছেন। নিজের ও সেই সাথে পরিবারের রক্ত ঢেলে তিনি শিখিয়ে গেছেন বাতিলের সাথে আপস নয় কখনোই।
শেষ কথা : কারো কাছে মাথা নত নয়, একমাত্র মহান স্রষ্টা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে নিয়ে তাঁকেই একমাত্র অধিপতি হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর কাছে মাথা নত করা এবং মহানবী সা: প্রদর্শিত পথে জীবনকে পরিচালনা করাই আশুরার মূল শিক্ষা। মূলত কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে জীবন গড়াই হবে প্রতিটি মুসলিমের পবিত্র দায়িত্ব।
লেখক : গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement