২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সুইজারল্যান্ডে ইসলাম

-


পর্বতমালা আর হ্রদের সমাহারে মধ্য ইউরোপের একটি সুন্দর দেশ সুইজারল্যান্ড। এটি ফেডারেল ধরনের একটি ছোট্ট রাষ্ট্র। দেশটির আয়তন ৪১ হাজার ২২৮ কিলোমিটার। স্থানীয় ভাষায় দেশটি ‘সুয়াতিনি’ নামে পরিচিত। কিংডম অব সুইজারল্যান্ড ১৬৪৮ সালে রোমান সাম্্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। তবে দেশটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১২৯১ সালে। দেশটির পশ্চিমে ফ্রান্স, উত্তরে জার্মানি, পূর্বে অস্ট্রিয়া ও দক্ষিণে ইতালি অবস্থিত। মাত্র ৮৩ লাখ জনসংখ্যার (২০১৬) এ দেশটি শিল্প-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন। দেশটির জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশই জার্মান অধিবাসী। এরা জার্মান ভাষায় কথা বলে। ২০ শতাংশ লোকের ভাষা ফ্রান্স আর ৪ শতাংশের ভাষা ইতালি। সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় ভাষা ফ্রান্স, জার্মান, ইতালিয়ান ও রোমান।
সুইজারল্যান্ডে ইসলাম : ইউরোপে বিশেষ করে স্পেনে ইসলামের আগমন ঘটে ৭১১ সালে। সেনাপতি তারিক ও মুসার নেতৃত্বে মুসলমানেরা স্পেন অধিকার করে। স্পেনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করলে সুইজারল্যান্ডে মুসলিম উপনিবেশ কায়েম হয়। মুসলমানেরা প্রায় ৭০০ বছর স্পেন শাসন করে। ৮৮৯ সালে ২০ জন আরব বণিক বাণিজ্যের উদ্দেশে স্পেন ত্যাগ করেন। তাদের জাহাজটি ঝড়ের কবলে পড়লে তারা কোনো মতে উপকূলে ভেড়ে এবং তারা আলপসের ঘন বনাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। এরপর তারা আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি ক্ষুদ্র এলাকায় বসতি স্থাপন করে। বর্তমানে এ এলাকাটিই সুইজারল্যান্ড রাষ্ট্র বলে পরিচিত। আরব বণিকদের আগমনের ফলে মুসলমানেরা এই এলাকায় ইসলামি সমাজ কায়েম করার সুযোগ পায়। তারা তখন আলপস পর্বতমালার বিভিন্ন স্থানে টাওয়ার নির্মাণ করেছিল। এই পর্বতমালার একটি বড় অংশ আরবদের অধিকারে থেকে যায়। একজন ফরাসি ঐতিহাসিক রেনাল্ট তার ‘বাই দি ওয়ে’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আরব মুসলমানেরা মুসলিম স্পেনের বাইরে উত্তর ফ্রান্স, ইতালি ও সুইজারল্যান্ডে বসবাস করত।’
১৪ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মুসলমান সুইজারল্যান্ডে গিয়ে বসবাস করতে থাকে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর অনেক মুসলমান দেশটিতে পাড়ি জমায়। মুসলমানদের মধ্যে কিছু অগ্রসর লোক সুইস মানুষের মধ্যে ইসলাম প্রচার করায় স্থানীয় অনেক মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সুইডিস কবি ফ্রিসহফ সোওয়ান। তিনি ‘ডে এন্ড নাইট’ বইয়ের প্রখ্যাত লেখক। ইসলাম গ্রহণের আগে ফ্রিসহফ সোওয়ান আলজেরিয়ায় চলে যান এবং সেখানে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে সোওয়ান সুইজারল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবেশ করেন।
সুইজারল্যান্ডে ইসলাম প্রচারের কাজ এগিয়ে গেলে অনেক সুইস অধিবাসী ইসলাম গ্রহণে এগিয়ে আসেন। ফলে দিন দিন মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তা ছাড়া দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকেও মুসলমানেরা প্রবাসী হিসেবে সুইজারল্যান্ডে এসে বসতি স্থাপন করে। ১৯৫১ (১৩৭১ হিজরি) সালের এক হিসাব অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে ব্যাপক মুসলমানের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় জেনেভায় (আলপস ও জুরা পর্বতমালা-বেষ্টিত একটি আধুনিক শহর। এটি বিশ্ব কূটনীতি ও ব্যাংকিংয়ের জন্য বিখ্যাত। এর জনসংখ্যা এক লাখ ৯৪ হাজার)। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সালের সুইজারল্যান্ডে ব্যাপক হারে মুসলিম নাগরিক বৃদ্ধি পায়। ফলে ১৯৮০ সালে দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা যেখানে ছিল ৫৬ হাজার (জনসংখ্যার ০.৯ শতাংশ) তা ১৯৯০ সালে বেড়ে হয় প্রায় ছয় গুণ। বর্তমানে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা চার লাখ। এর মধ্যে ৮৮.৩ শতাংশ প্রবাসী মুসলিম। প্রবাসীদের ৫৬.৪ শতাংশ সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার নাগরিক (বিশেষ করে বলকান ও কসোভোর নাগরিক), ৬ শতাংশ তুরস্ক ও ৩.৪ শতাংশ আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আগত। মুসলমানদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার স্থানীয় অধিবাসী।
সুইজারল্যান্ডে ইসলামি প্রতিষ্ঠান : সুইজারল্যান্ডে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয় ১৯৬৩ সালে জুরিখে সুইজারল্যান্ডের অন্যতম শহর জেনেভায় নামাজের ব্যবস্থা হিসেবে একটি ইসলামি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয় সত্তরের দশকে। তবে এটি বেশি দিন টেকেনি। ১৯৭২ সালে (১৩৯২ হিজরি) সুইজারল্যান্ডে মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম ইসলামি সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ সংগঠনের কমিটি সুইজারল্যান্ডে মসজিদ ও ইসলামি সেন্টার নির্মাণের অনুমোদনও পেয়েছিল।
সৌদি আরবের বাদশাহ কিং ফয়সাল ইবনে আবদুল আজিজ আল-সৌদ ১৯৭৩ সালে সুইজারল্যান্ড সফর করেন। তিনি ইসলামি সেন্টারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এটি ‘কিং ফয়সাল সেন্টার’ নামে পরিচিত ছিল। সেন্টারে একটি লাইব্রেরি ও একটি ইসলামি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুসলিম ছেলেমেয়েদের এখানে বিনা খরচে লেখাপড়ার সুযোগ দেয়া হয়।
পত্রিকার মাধ্যমে সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের ঈমান-আকিদা রক্ষার চেষ্টা করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে (১৩৯৮ হিজরি) জেনেভায় ইসলামি সেন্টারটি নির্মাণ করা হয়। সৌদি আরবের বাদশাহ কিং খালিদ ইবনে আবদুল আজিজ আল-সৌদ এই সেন্টারের উদ্বোধন করেন। সুইজারল্যান্ডে ১৯৮০ সালের দিকে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। জুরিখে ১৯৮৯ সালে ‘জ্যামেইনশাফট ইসলামশার অর্গানাইজেশন দার সেচউইঝ’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে অনেক ইসলামি সংগঠন সুইজারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ‘অর্গানাইজেশন মুসলিম এ- মুসলিমিন দার সেচউইঝ, ভেরেইনিগাংগ ইসলামশার অর্গানাইজেশন জুরিখ (১৯৯৫), বাসলার মুসলিম কমিশন সেচউইঝ, বাসেল (১৯৯৭), কো-অর্ডিনেশন ইসলামশার অর্গানাইজেশন সেচউইঝ (২০০০) ইত্যাদি।
উপসংহার : সুইজারল্যান্ডে ইসলামের প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানেরা কাজের প্রয়োজনে, পড়ালেখার জন্য অথবা গবেষণার কাজে দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এটা মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। তা ছাড়া বর্তমান পতনশীল ইউরোপের বেলাভূমিতে যে হতাশা ও ক্ষয়ের সূচনা হয়েছে, তার কারণেও মানুষ ইসলামের কালজয়ী আদর্শের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটিতে জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ১৫ লাখে। আমরা প্রত্যাশা করি, একদিন সুইজারল্যান্ডের মুসলমানেরা শক্ত ভিত্তি রচনা করবে এবং দেশটির উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement