২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নামাজে সুফল পেতে হলে করণীয়

-


আল্লাহ ইসলামি শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং নামাজ-রোজা মুসলমানদের কল্যাণ ও উপকারের জন্যই দিয়েছিলেন। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং নামাজ-রোজার বদৌলতে মুসলমানেরা অর্ধপৃথিবী জয় ও শাসন করেছিল। সব ধরনের জাগতিক ও পারলৌকিক উপকার এবং কল্যাণ এর মধ্যেই নিহিত। মুসলমানদের নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি ও বিধিবিধানও সামষ্টিক ও রাষ্ট্রভিত্তিক। তাই জুমা ও ঈদের নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে ইমামতি করার দায়িত্বও ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধান অথবা তার নিযুক্ত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির। মুসলিম দেশে ইসলামি সরকার না থাকায় এখন বেতনভুক্ত আলেমগণই এসব নামাজে ইমামতি করেন এবং খুতবা (ভাষণ) দেন। কারণ এখন ইসলামি সরকার নেই, ইসলামি সরকারের প্রতিনিধিও নেই। আল্লাহ তায়ালা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণের যে ফজিলত এই নামাজ-রোজা ও ইবাদতগুলোতে দিয়েছেন, তার থেকে মুসলিম উম্মাহ আজ বঞ্চিত কেন, এটাই চিন্তার বিষয়। কেন পরিবর্তন হয় না তাদের চরিত্রের? তাহলে কি নামাজ-রোজায় কোনো ফল ও ফজিলত নেই। নাকি ইসলামের বিধিবিধান ও ইবাদতগুলো কোনো উপকার ও কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ? তাহলে ইসলামের সোনালি যুগের ওপর লিখিত ইতিহাস কি মিথ্যা?

নামাজ-রোজার বিধান
আল্লাহ তায়ালা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। নামাজ ঠিকভাবে আদায় করার জন্য তাগিদ দিয়ে বারবার আদেশ জারি করেছেন। আল্লাহর নবী সা: জামাতে নামাজ আদায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, যারা জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যায় না, ঘরে আগুন দিয়ে তাদের জ্বালিয়ে দেয়ার ােভ ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ ক্ষমতাবান মুসলমান ও মুসলিম সরকারপ্রধানদের সমাজ ও রাষ্ট্রে নামাজ চালু করার আদেশ দিয়ে বলেন, আমি যদি তাদেরকে জমিনে ক্ষমতাসীন করি তাদের দায়িত্ব হলো নামাজ কায়েম করা। এখন কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা নামাজ কায়েম করা তো দূরের কথা, নিজেরাই নামাজ পড়ে না। রোজার ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে-ই রমজান মাস পাবে, সে যেন পুরো মাস রোজা রাখে। এই রমজান মাসেই মানুষের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ কুরআন নাজিল করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেন তোমরা তাকওয়া লাভ করতে পারো। আল্লাহ বলেন, যারা তাকওয়া অর্জন করবে, তাদের কাজ সহজ করে দেয়া হবে। কল্পনাতীত উপায়ে তারা রিজিক পাবে। তাদের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার পথ সুগম করা হবে। গুনাহগুলো মিটিয়ে দেয়া হবে। (আল কুরআন)।

নামাজ-রোজার ফল ও ফজিলত
যারা মুসলমান তাদের প্রধান ও মৌলিক কাজ হলো নামাজ কায়েম করা, রোজা পালন করা। যারা ঠিকভাবে নামাজ-রোজা করবে, তারা মুত্তাকি হবে। আল্লাহর কথা স্মরণ হলে তাদের দিল নরম হবে, কুরআন শুনলে ঈমান বেড়ে যাবে। অশ্লীলতা পরিহার করবে। অন্যায় বর্জন করবে। তারা ন্যায়পরায়ণ ও অন্যায় নির্মূলকারী ও অশ্লীলতা উচ্ছেদকারী হবে। তারা হবে মানবপ্রেমিক ও দেশপ্রেমিক এবং নিরপেক্ষমনা। দুর্নীতিমুক্ত হবে তাদের জীবন। খোদাভীরু, ত্যাগী ও পরোপকারী হবে তারা। তারা হবে অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ও সরব। নামাজ আদায়কারীরা জান্নাতের চাবি হাতে পাবেন, আর রোজা পালনকারীরা স্বয়ং আল্লাহর হাত থেকে পুরস্কার নিতে পারবেন।

নামাজ-রোজার ফল পাওয়া যায় না কেন
প্রতিদিন ইবাদত হিসেবে নামাজ আদায় এবং মাসব্যাপী রোজা রাখার পরও অনেক মুসলমান আগের মতোই দুর্নীতিবাজ, অন্যায় ও অপকর্মকারী, লোভী, সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী, জুলুমবাজ, নারী নির্যাতনকারী, ঘুষখোর, আত্মসাৎকারী, মতার অপব্যবহারকারী, সুদখোর এবং ইসলামি আইন ও শাসনের বিরোধিতাকারী, অন্যায় ও জুলুমকারীর সহযোগী থেকে যাচ্ছে। নিচে তার কিছু কারণ উল্লেখ করা হলোÑ
১. জেনে-বুঝে অর্থসহ মুহাব্বতের সাথে আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে নিজেকে সংশোধনের নিয়তে তাকবিরে উলার সাথে নিয়মিত নামাজ-রোজা আদায় না করার কারণে ফল পাওয়া যায় না। আল্লাহর নবী সা: বলেন, ‘অনেক রোজাদার আছে রোজা রেখে উপোষ থাকা ছাড়া কিছুই পায় না। অনেক কিয়ামকারী আছে রাত জেগে তারা রাত জাগা ছাড়া আর কিছু পায় না।’ আল হাদিস।
২. ইসলামি জ্ঞানহীনতার এবং ইসলামি অনুভূতি ও আগ্রহের অভাবের কারণে মুসলমানরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ইসলামবিমুখ হওয়ায় নামাজ-রোজার সুফলপ্রাপ্তি থেকে তারা হতাশাজনকভাবে বঞ্চিত। আল্লাহর নবী বলেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ।’ (আল হাদিস)।
৩. দেশে ইসলামি নেতৃত্ব ইসলামি শাসন ও পরিবেশ না থাকার কারণে মানুষ নামাজ-রোজার ফল পাচ্ছে না। আল্লাহর নবী সা: বলেন, ‘তোমাদের নেতা যে রকম হবে, তোমরাও সে রকম হবে।’ (আল হাদিস)।
৪. ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ আদর্শ হিসেবে বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ ও মান্য না করার কারণে নামাজ-রোজার প্রকৃত ফল মানুষ পাচ্ছে না। আল্লাহ বলেছেন, ‘জনপদের লোকেরা যদি আল্লাহকে বিশ্বাস করে খোদাভীতির জীবন যাপন করে, আমি তাদের জন্য আসমান জমিনের বরকতের সব দরজা খুলে দেবো।’ (আল কুরআন)। আল্লাহর রাসূল সা: হাদিসে বলেছেন, ‘আল্লাহ বলেন, আমি তাদের জন্য রাতে বৃষ্টি দেবো, দিনে রোদ দেবো, বজ্রের আওয়াজও দেবো না।’ (আল হাদিস)।
৫. ব্যক্তিগত জীবনে তাকওয়ার অভাব এবং ঈমান-আমলের দুর্বলতার কারণে নামাজ-রোজার ফল পাওয়া যায় না।
৬. হারাম উপার্জন করার এবং অন্যায় ও পাপকাজে লিপ্ত থাকার কারণেও নামাজ-রোজার ফল মানুষ পায় না। আল্লাহর নবী সা: বলেন, ‘এক ব্যক্তি অনেক দূর থেকে এসে খানায়ে কাবায় দোয়া করে অথচ খাদ্যে হারাম, পরনে হারাম, তার দোয়া কিভাবে কবুল হবে?’ (আল হাদিস)।
৭. যেসব আলেম ও ইমাম মানুষকে অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে বলেন; তাদের সামাজিক কোনো প্রভাব না থাকায় ওইসব অপকর্ম বন্ধে তাদের বলিষ্ঠ কোনো ভূমিকা না থাকায় এবং কোনো কোনো েেত্র অন্যায় অপকর্মকারীদের সাথে ওইসব আলেম, ইমাম ও পীর-মাশায়েখদের সখ্য থাকায় নামাজ-রোজার ফল থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের পীর-মাশায়েখরা কেন অন্যায়, হারাম ও পাপকাজে বাধা দেয় না?’ (আল কুরআন)।
৮. নিয়তের গোলমাল, নিয়তের ওপরই নির্ভর করে মুমিনের কাজের ফলাফল। প্রিয়নবী সা: বলেন, ‘ইন্নামাল আমালু বিন্নিয়াত।’ আল্লাহ বলেছেন, ‘নামাজ অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখবে।’ (আল কুরআন)।
৯. সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, মুসলমানেরা নামাজ-রোজাও করে আবার আল্লাহর সাথে শিরিকও করে। ফলে নামাজ-রোজার ফল পাওয়া যায় না। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহর সাক্ষাৎ প্রত্যাশী সে যেন তার প্রভুর ইবাদতে (অর্থাৎ আনুগত্য, গোলামি ও আদেশ পালনে) অন্য কাউকে শরিক না করে।’ (আল কুরআন)।
১০. আগের জামানায় মুসলমান জনগণ, সরকার ও সরকারের লোকেরা ব্যক্তিগতভাবে হলেও ঈমানদার ও খোদাভীরু ছিল। এখন মুসলমান জনগণ, সরকার ও সরকারের লোকেরা মুনাফেক মার্কা এবং খোদা ও আখেরাত-বিমুখ হওয়ার কারণে তারা নামাজ-রোজার সুফল পায় না।
১১. আগের জামানায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের পক্ষে কাজ না করলেও ইসলামের বিরুদ্ধে তেমন কাজ করেনি, আর এখন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মানুষকে ইসলামবিমুখ করার কাজ বেশি, এ কারণে মানুষ নামাজ-রোজার ফল লাভ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
১২. আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখদের অনৈক্য, কোন্দল, গ্রুপিং, বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে মানুষ সন্দেহপরায়ণ ও বিভ্রান্ত হয়ে আগ্রহহীনতার শিকার হওয়ার ফলে নামাজ-রোজার ফল লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
১৩. রাজনীতি ও রাষ্ট্র ইসলামি শাসনবিমুখ হওয়ার কারণে মানুষ নামাজ-রোজার প্রকৃত ফল লাভ করতে পারছে না। আল্লাহর নবী বলেন, ‘তোমরা শিগগিরই দেখবে শাসন থেকে কুরআন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তখন তোমাদের শাসকেরা এমন আদেশ দেবে, যা পালন করলে গুনাহ হবে, অমান্য করলে শাসকেরা তোমাদের হত্যা করবে। আল হাদিস।

নামাজ-রোজার ফল পাওয়া যাবে কিভাবে
যে জাতের ও যে মানের মুসলমানদের জন্য আল্লাহ নামাজ-রোজা দিয়েছেন, মুসলমানদের সে জাতের, সে মানের মুসলমান হতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ইসলামি শাসন, ইসলামি সমাজ, ইসলামি পরিবেশ ও ইসলামি মননশীলতার। প্রয়োজন ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ হিসেবে বিশ্বাস, গ্রহণ ও মান্য করার। তাহলেই নামাজ-রোজার প্রকৃত সুফল ও বৃহত্তর কল্যাণ লাভ করা যাবে। ইসলামবিমুখ সমাজ ও পরিবেশে বাস করে ইসলাম ও নামাজ-রোজার প্রকৃত সুফল লাভ করা কোনো দিনই সম্ভব নয়। এর জন্য কিন্তু ১ নম্বরে দায়ী ধর্মীয় নেতা ও পীর-মাশায়েখ, যারা জাগতিক স্বার্থ ও লোভের কারণে হক কথা মানুষকে বলেন না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না; বরং অন্যায়কারীর সাথে তাল মিলিয়ে চলেন এবং রাসূল প্রদর্শিত রাজনীতির ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেন। ২ নম্বরে দায়ী রাজনৈতিক নেতা-কর্মকর্তারা, যারা মুসলমান হয়েও জাগতিক স্বার্থ ও ক্ষমতার জন্য ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ ও বিরোধিতায় লিপ্ত এবং জেনেবুঝেই নামাজ-রোজা ত্যাগ করেন, ইসলামি রাজনীতি ও শাসননীতির বিরোধিতা করেন। অথচ আল্লাহর রাসূল সা: ইসলামি সমাজ, রাষ্ট্র ও ইসলামি পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা প্রতিষ্ঠা করা মুসলমান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের জন্যও ফরজ। ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র ছাড়া কুরআনবর্জিত আইন ও শাসনের অধীনে থেকে নামাজ-রোজার প্রকৃত সুফল লাভ করা অসম্ভব। সম্ভব নয় প্রকৃত শান্তি ও উন্নতি লাভ করা। এর জন্য প্রয়োজন ইসলামি রাজনীতি, ইসলামি পরিবেশ ও কুরআনের শাসন।
লেখক : খতিব


আরো সংবাদ



premium cement