২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইতেকাফের ফজিলত

-


ইতেকাফ একটি আরবি শব্দ। এটি আরিব ‘আকফ’ ধাতু থেকে উদ্গত। আকফ শব্দের অর্থ হচ্ছে অবস্থান করা। ইতেকাফ মানে মসজিদে নিজেকে আটকে রাখা। ইতেকাফের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো স্থানে আটকে যাওয়া বা থেমে যাওয়া, অবস্থান করা আবদ্ধ হয়ে থাকা। প্রচলিত অর্থে রমজানের শেষ ১০ দিন জাগতিক কাজ কর্ম ও পরিবার পরিজন থেকে অনেকটা বিছিন্ন হয়ে শুধু আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে রাজি-খুশি করার নিয়তে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ইবাদাত করার উদ্দেশ্যে অবস্থান করা, স্থির থাকা, আবদ্ধ হয়ে থাকাকে ইতেকাফ বলে। যিনি ইতেকাফ করেন তাকে মুতাকিফ বলে।
কুরআন ও হাদিসে ইতেকাফ : ইতেকাফ শরিয়াসম্মত একটি আমল হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। যেমন :
‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে (কাবা) তাওয়াফকারীদের জন্য, ইতেকাফকারীদের জন্য ও (সর্বোপরি তার নামে) রুকু-সিজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখে’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১২৫)।
‘আর মসজিদে যখন তোমরা ইতেকাফ অবস্থায় থাকবে তখন স্ত্রী-সম্ভোগ থেকে বিরত থেকো। সিয়ামের ব্যাপারে এগুলোই হলো আল্লাহ্র সীমারেখা’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৭)।
আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানে শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতেকাফ করেছেন (বুখারি ও মুসলিম)।
মা আয়শা (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর রমজানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করতেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি এই নিয়ম পালন করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীগণ এই নিয়ম জারি রাখেন (বুখারি)।
ইতেকাফের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : মা আয়শা (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা) থেকে বর্ণিত, যখন রমজানের শেষ ১০ দিন আসত তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোমর বেঁধে নামতেন অর্থাৎ বেশি বেশি ইবাদত করার প্রস্তুতি নিতেন এবং রাতে জেগে থাকতেন ও পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন (বুখারি)।
ইতেকাফ মূলত তিন প্রকার : ওয়াজিব ইতেকাফ, সুন্নাত ইতেকাফ ও মুস্তাহাব বা নফল ইতেকাফ।
ক. ওয়াজিব ইতেকাফ : মান্নতের ইতেকাফকে ওয়াজিব ইতেকাফ বলে। কেউ যদি ইতেকাফ করার জন্য মান্নত করে তবে তাকে তা পূরণ করতেই হবে।
খ. সুন্নাত ইতেকাফ : রমজানের শেষ ১০ দিন যে ইতেকাফ করা হয় তাকে সুন্নাত ইতেকাফ বলে। যা আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবিগণ করেছেন। সুন্নাত ইতেকাফ সিয়াম পালনরত অবস্থায় করতে হয়।
গ. মুস্তাহাব বা নফল ইতেকাফ : রমজানের শেষ ১০ দিন ছাড়া অন্য যেকোনো সময় যে ইতেকাফ করা হয় তাকে মুস্তাহাব বা নফল ইতেকাফ বলে। এটি বছরের যেকোনো সময়, যেকোনো মাসে, যেকোনো দিনে করা যায়।
ইতেকাফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : ইতেকাফের অন্যতম লক্ষ্য হলো লাইলাতুল কদরের রাতের যে অগণিত ফজিলত রয়েছে তা অর্জন করা এবং কদরের মর্যাদাময় রাত যেন কোনোক্রমে বাদ না পড়ে সেজন্য নিজেকে সদা ইবাদাতে নিয়োজিত রাখা। নিশ্চিতভাবে লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ ১০ দিনের মধ্যে রয়েছে, যা নিরবচ্ছিন্নভাবে রাত জাগরণের মাধ্যমে পাওয়ার চেষ্টা করতে হয়। মোট কথা কোনোক্রমেই যেন লাইলাতুল কদর হাতছাড়া না হয়।
ইতেকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করা।
ইতেকাফের উপযুক্ত স্থান কোনটি বা কোথায় : ইতেকাফের জন্য কুরআন ও হাদিসের নির্দেশিত জায়গা হচ্ছে মসজিদ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ সংক্রান্ত পদক্ষেপ ও নির্দেশনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়; ইতেকাফ মসজিদে হতে হবে। বিশেষজ্ঞ আলেমদের মত হচ্ছে, ইতেকাফ করবেন সেই মসজিদে যেখানে নিয়মিতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতে আদায় হয়। বিশেষ করে সেখানে যেন জুমার সালাত আদায় হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতেকাফ কোথায় এবং কখন : ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতেকাফ হচ্ছে মসজিদুল হারামে আদায়কৃত ইতেকাফ, যেটি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত। তারপর মসজিদে নববীতে (মদিনায় নবীর মসজিদে) আদায়কৃত ইতেকাফ, তারপর বায়তুল মোকাদ্দাসে (যেটি জেরুসালেমে অবস্থিত) আদায়কৃত ইতেকাফ। এরপর যেকোনো জামে মসজিদে।
ইতেকাফের সবচেয়ে উত্তম সময় হচ্ছে রমজানের শেষ ১০ দিন।
দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ সময় : ক. প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর। খ. সিজদারত অবস্থায়। গ. রাতের শেষ তৃতীয়াংশে। ঘ. আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়। ঙ. সিয়ামরত অবস্থায়। চ. ইফতার করার পূর্বক্ষণে। ছ. লাইলাতুল কদরের রাতে। জ. জুমার দিন।
ইতেকাফকারীর জন্য যেসব কাজের অনুমতি রয়েছে : ক. ইতেকাফকারী মসজিদে পানাহার ও ঘুমাতে পারবে; তবে কম খাওয়া এবং কম ঘুমানো ইবাদতের জন্য সহায়ক। এ সময় ইতেকাফের হক ও মসজিদের আদবের প্রতি যতœশীল হতে হবে। খ. একান্ত প্রয়োজনে বা অস্বস্তিবোধ করলে গোসল করা যাবে তবে নিয়মিত সাধারণ গোসল না করা ভালো। গ. চুল আঁচড়ানো, তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার, পোশাক পরিবর্তন ইত্যাদির অনুমতি আছে। ঘ. পরিবারের কেউ দেখা করতে এলে তাকে সাক্ষাৎ দেয়া, কথা বলা ইত্যাদি করা যাবে; তবে তা যেন দীর্ঘ না হয়। ঙ. প্রস্রাব-পায়খানা ও অজু করার জন্য বাইরে যাওয়া জায়েজ, তবে এসব যেন মসজিদের কাছাকাছি হয়। চ. খাবার নিয়ে আসার লোক না থাকলে বা মসজিদে খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে বাইরে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে।
ছ. কোনো কারণে মসজিদে আগুন লেগে গেলে বা মসজিদ ভেঙে পড়া ও ধসে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হলে ইতেকাফের স্থান থেকে বের হওয়া যায়।
জ. ইতেকাফকারীর অবস্থান যদি এমন মসজিদে হয় যেখানে জুমার জামাত হয় না, সে ক্ষেত্রে শুধু জুমার সালাত আদায়ের জন্য বের হতে পারবে।
ইতেকাফকারীকে যেসব কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে
ওই সব কাজ থেকে ইতেকাফকারী বিরত থাকবেন, যে কাজ করলে ইতেকাফের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। যেমন বেশি কথা বলা, বেশি মেলামেশা করা, বেশি ঘুমানো, টেলিফোনে গল্প গুজব করা, ইন্টারনেট ব্রাউজ করা, অন্যের সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকা, ঝগড়া-ঝাটি করা, অন্যের গিবত করা, ইতেকাফের মূল সময়কে কাজে না লাগানো ইত্যাদি। ইতেকাফকারী মসজিদে অবস্থানকালে বিশেষ শরিয়া ওজর ছাড়া ক্রয় বিক্রয়ে লিপ্ত হবে না। রোগীর সেবা করতে ও জানাজায় অংশ নিতে বের হবে না। ইতেকাফের শুরুতে কেউ যদি এ জাতীয় কোনো শর্ত করে নেয়, তবে তার কথা ভিন্ন।
কোন কাজগুলো করলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যায় তথা ভেঙে যায় : ক. বিনা প্রয়োজনে ইতেকাফের স্থান থেকে বের হলে। খ. শিরক বা কুফরি কাজে লিপ্ত হলে।
গ. অজ্ঞান বা পাগল হয়ে গেলে, মাতাল হয়ে পড়লে।
ঘ. স্ত্রী সহবাস বা যেকোনো প্রকার যৌনাচারে লিপ্ত হলে। ঙ. নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে বা গর্ভপাত হলে; হায়েজ-নিফাস শুরু হলে।
একজন ইতেকাফকারীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ইতেকাফের মাধ্যমে আপনি কী অর্জন করেছেন?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ইতেকাফের এ দিনগুলোতে মসজিদে অবস্থানকালীন সময়ে আমি অন্তরে চরম প্রশান্তি অনুভব করেছি এবং আমার মনে হয়েছে আমার অনেক চাওয়া-পাওয়া আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে এখানেই পূরণ করে দিয়েছেন।
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement