২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মশারি টানানোয় মশা এখন দিনে কামড়ায় বেশি!

মশারি টানানোয় মশা এখন দিনে কামড়ায় বেশি! - ছবি : সংগৃহীত

নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী মশা লোকজনকে যত কামড় দিয়ে থাকে তার ৩০ শতাংশই ঘটে দিনের বেলায় এবং ঘরের ভেতরে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই তথ্যের কারণে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে প্রচলিত ব্যবস্থাগুলোর বিষয়ে নতুন করে ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

বর্তমান কর্মসূচিতে রাতের বেলায় মশার কামড়ানোর ওপরেই জোর দেয়া হয়। যে কারণে রাতের বেলায় কীটনাশক মেশানো মশারি টানিয়ে ঘুমানোর কথা বলা হয়।

এনোফিলিস নামের এক নারী মশার মাধ্যমে এই রোগটি ছড়িয়ে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ২০২০ সালে সারা বিশ্বে ২৪ কোটি ১০ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে সোয়া ছয় লাখেরও বেশি মানুষের, যার বেশিরভাগই ঘটেছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে।

৩০ ভাগ কামড় দিনের বেলায়
এত দিন ধারণা করা হতো যে মশা সাধারণ রাতের বেলায় কামড়ায়। তবে সম্প্রতি সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের রাজধানী বাঙ্গুইতে এবিষয়ে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, যাতে দেখা গেছে মশা দিনের বেলাতেও প্রচুর কামড়ায়।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শহরের চারটি স্থান থেকে এই গবেষণার জন্য স্বেচ্ছাসেবীরা মশা সংগ্রহ করেন। যখনই কোনো মশা তাদের গায়ের ওপর বসেছে, কামড়ানো শুরু করার আগেই তাদেরকে ধরে কাচের খাঁচার ভেতরে রেখে দেয়া হয়।

মশা সংগ্রহ করতে যারা কাজ করেছেন তাদের ম্যালেরিয়া-প্রতিরোধী ওষুধ দেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়েছে।

এই গবেষণার জন্য আটটি ভিন্ন প্রজাতির প্রায় আট হাজারের মতো মশা সংগ্রহ করা হয় যেগুলো ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করছিল।

গবেষকরা বলছেন, মশার কামড়ানোর বেশিরভাগই ঘটে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত। তবে তারা এটা দেখে বিস্মিত হয়েছেন যে এর ৩০ শতাংশ ঘটে দিনের বেলাতেই এবং ঘরে ও অফিস আদালতের ভেতরে।

মশার আচরণে পরিবর্তন
বাংলাদেশেও এধরনের কিছু গবেষণা হয়েছে যাতে অনেক মশার আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার, যিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মশা নিয়ে গবেষণা করছেন, তিনি বলেছেন যে নানা চাপের কারণে একটি মশার আচরণে পরিবর্তন ঘটে থাকে।

'আমরা জানি ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সকালে ও সন্ধ্যায় কামড়িয়ে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি আমার এক গবেষণায় দেখেছি এডিস মশা এখন রাতেও কামড়ায়। এর অর্থ তার আচরণে পরিবর্তন ঘটেছে,' বলেন তিনি।

বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ার প্রাথমিক বাহক এনোফিলিস মশার চারটি প্রজাতি- এনোফিলিস বাইমাই, এনোফিলিস ফিলিপেনিনসিস, এনোফিলিস ফানডাইকা ও এনোফিলিস মিনিমাস।

এছাড়াও রয়েছে আরো তিনটি সেকেন্ডারি ভেক্টর- এনোফিলিস একোনিটাস, এনোফিলিস এনোলারিস এবং এনোফিলিস ভেগাস।

এই সাতটি প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় ভেক্টর এনোফিলিস বাইমাই।

বিজ্ঞানী কবিরুল বাশার বলেন, এনোফিলিস বাইমাইর আচরণে এত দিন দেখা গেছে যে এটি বনভূমির আশেপাশে পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি থাকে এবং এটি ঘরের বাইরে কামড়াতে পছন্দ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে এই মশাটির আচরণে পরিবর্তন ঘটছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে পরিবেশগত কিছু পরিবর্তন ঘটছে। বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে এই মশাটিরও আচরণগত কিছু পরিবর্তন ঘটছে।

তিনি বলেন, 'এনোফিলিস মিনিমাস প্রজাতি বন জঙ্গলে যেসব বাড়িঘর আছে তার কাছাকাছি থাকত। কিন্তু ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য সমস্ত বাসাতে কীটনাশকযুক্ত মশারি সরবরাহ করা হয়েছে। এর ফলে মশাটি চাপের মুখে পড়েছে এবং পরিণতিতে এটি তার চারিত্রিক কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছে।'

গবেষণায় দেখা গেছে মশারি দেয়ার পরেও কিছু কিছু জায়গায় ম্যালেরিয়া হচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে গবেষকরা দেখেন যে মশারির চাপের কারণে মশাটি তাদের আচরণের পরিবর্তন ঘটিয়ে ঘরের বাইরে কামড়াতে শুরু করেছে।

তবে বাংলাদেশে মশার কামড়ের কত শতাংশ দিনে এবং কতো শতাংশ রাতে ঘটে থাকে এরকম সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা হয়নি।

বাশার বলেন, বন জঙ্গল এলাকাতে এনোফিলিসি মশা দিনের বেলায়ও কামড়াতে পারে।

'কারণ সেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। একারণে মশা ভুল করে থাকে,' বলেন তিনি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এনোফিলিস ভেগাস প্রজাতি দিনের বেলায় ঘরের ভেতরে বিশ্রাম নিতে পছন্দ করে। তাই এটি দিনের বেলাতেও ঘরের ভেতরে কামড়াতে পারে।

কখন কামড়ায়- জানা কেন জরুরি
মশা কখন কামড়ায় তার এই আচরণের ওপর ভিত্তি করেই মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি তৈরি করা হয়।

ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী এনোফিলিস মশার কোনো প্রজাতি যদি রাতের বেলায় কামড়ায় তাহলে লোকজনকে মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।

এপ্রসঙ্গে অধ্যাপক কবিরুল বাশার এডিস মশার আচরণের উদাহরণ দিয়েছেন।

'ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দিনের বেলায় সকালে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তাই ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই সময়টাতে মশার কামড় থেকে রক্ষা করার কথা বলা হয়। সেধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে,' বলেন তিনি।

তিনি বলেন, এখন যেহেতু মশার আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে সে কারণে মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকেও সেভাবে সাজাতে হবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মশা যেহেতু দিনের বেলাতেও কামড়ায় সেকারণে ম্যালেরিয়া-বিরোধী কর্মসূচিকে এখন ঘরের বাইরে স্কুল, অফিস আদালত ও দোকানপাটেও বিস্তৃত করতে হবে।
সূত্র : বিবিসি

 


আরো সংবাদ



premium cement