‘মগজখেকো’ অ্যামিবাতে আক্রান্ত হয়েও বেঁচে গেল কেরালার কিশোর
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩০ জুলাই ২০২৪, ০৯:৫৫
‘ব্রেন ইটিং অ্যামিবা’ সৃষ্ট রোগের কবলে পড়েও আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে ফিরেছেন ভারতের কেরালার ১৪ বছরের এক কিশোর। আফনান জসিম নামে দশম শ্রেণীর ওই শিক্ষার্থী বিশ্বের নবম ব্যক্তি, যিনি এই জীবনঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়েও বেঁচে গিয়েছেন।
মস্তিষ্কে আক্রমণকারী এই আণুবীক্ষণিক জীবাণু যে রোগ সৃষ্টি করে তাতে মৃত্যুর হার ৯৭ শতাংশ।
‘ব্রেন ইটিং অ্যামিবা’ বা মস্তিষ্ক ভক্ষণকারী অ্যামিবায় আক্রান্ত হয়ে কেরালার কোঝিকোড়ের এক হাসপাতালে ২২ দিন ধরে চিকিৎসাধীন থাকার পর শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান এই ভারতীয় কিশোর।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তার সুস্থ হয়ে ওঠার পেছনে মূল কারণ হলো প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল এই রোগকে।
শুধুমাত্র আফনান জসিমই নন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময় এই জীবনঘাতী রোগে আক্রান্ত যে আটজনকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রেও কারণ সেই একই- সময় মতো রোগ শনাক্ত করা ও চিকিৎসা শুরু করা গিয়েছিল।
প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোয়েন্সফালাইটিস (পিএএম) নামে পরিচিত এই রোগের জন্য দায়ী ‘নিগলেরিয়া ফওলেরি’ নামক অ্যামিবা- যাতে আক্রান্ত হলে জীবনের তীব্র ঝুঁকি রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ১৯৭১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও পাকিস্তানের মতো চারটি দেশে এই প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়েও এর আগে বেঁচে গিয়েছেন মাত্র আটজন।
গবেষণা বলছে, আক্রান্ত হওয়ার নয় ঘণ্টা থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে এই রোগ ধরা পড়লে তবেই বেঁচে ফেরা সম্ভব।
এই বিরল অ্যামিবার কারণে সৃষ্ট রোগের সাথে লড়াইয়ের পর বেঁচে ফেরা বিশ্বের নবম ব্যক্তি আফনান জসিমের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল এবং সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
হঠাৎ এই কিশোরের তীব্র মাথা ব্যথা হতে থাকে। পরে তার খিঁচুনি শুরু হওয়ায়, আফনান জসিমের পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। দ্রুত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
চিকিৎসার প্রথম দু’দিন তিনি খিঁচুনির পরবর্তী অবস্থায় (এই রোগে আক্রান্ত হলে যে লক্ষণ দেখা যায় তার পর্যায় অনুযায়ী) ছিলেন।
কোঝিকোড়ের বেবি মেমোরিয়াল হাসপাতালের কনসালট্যান্ট পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভিস্ট ডা. আব্দুল রউফ বলছিলেন, ‘আফনানকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তত দিনে এই রোগে কেরালায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি মামলা আমাদের কাছে অনেক পরে রেফার করা হয়েছিল। ওই সময় আমরা সরকারকে জানাই যে এটা একটা জনস্বাস্থ্যমূলক সমস্যা এবং এর সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো উচিত।’
সময় মতো যে আক্রান্ত কিশোরের চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয়েছিল তার কৃতিত্ব অবশ্য ডা. আব্দুল রউফ দিয়েছেন আফনান জসিমের বাবা এম কে সিদ্দিকীকে।
কিভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন ওই কিশোর?
আফনান জসিমের বাবা পশুপালন পেশার সাথে যুক্ত। ৪৬ বছর বয়সী এই ব্যক্তি জানান, দিন কয়েক আগে তার ছেলে কোঝিকোড় জেলার পায়োল্লি পৌরসভার অন্তর্গত টিক্কোটি গ্রামের একটা পুকুরে সাঁতার কাটতে নেমেছিলেন।
এম কে সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিপাহ ভাইরাসের উপসর্গের কথা পড়ছিলাম, তখনই এই অ্যামিবা সম্পর্কে জানতে পারি। আমি সংক্রমণের কারণে খিঁচুনির কথাও পড়েছি। আফনানের খিঁচুনি শুরু হলে আমি তাকে স্থানীয় একটা হাসপাতালে নিয়ে যাই। এরপরেও ওর খিঁচুনি বন্ধ না হওয়ায় ওকে ভাদাক্কারার অন্য একটা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। ওই হাসপাতালের তরফেই আফনানকে বেবি মেমোরিয়াল হাসপাতালে রেফার করে দেয়া হয়।’
ছেলের খিঁচুনি বন্ধ না হওয়ার কারণ চিকিৎসকের কাছ থেকে জানতে চান সিদ্দিকী। এর আগে ওই কিশোরের এ জাতীয় কোনো সমস্যা হয়নি।
আফনানের বাবা বলেন, ‘আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেন ওর খিঁচুনি হচ্ছে, কারণ এর আগে তো কখনো খিঁচুনি হয়নি। ওই সময় আমি ডাক্তারকে বলেছিলাম, পাঁচ দিন আগে আফনান পুকুরে সাঁতার কাটতে গিয়েছিল। এরপরই ও মাথা যন্ত্রণার কথা বলে আর পরে জ্বরও আসে।’
কিভাবে মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায় এই অ্যামিবা?
নাক দিয়ে মানবদেহে ঢোকে নিগলেরিয়া ফওলেরি। সেখান থেকে খুলির কাছে অবস্থিত ক্রিব্রিফর্ম প্লেটের মাধ্যমে পৌঁছে যায় ব্রেনে।
ডা. রউফ বলেন, ‘এটা এক প্রকারের প্যারাসাইট (পরজীবী) যা বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল নিঃসরণ করে এবং মস্তিষ্ককে নষ্ট করে দেয়।’
এই অ্যামিবা যে রোগের সৃষ্টি করে তার প্রধান লক্ষণগুলো হলো জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, গলা শক্ত হয়ে যাওয়া, সংজ্ঞা হারানো, খিঁচুনি এবং কোমার মতো পরিস্থিতিতে চলে যাওয়া। মাথার খুলিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ার কারণে বেশিভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়ে থাকে।
ডা. রউফ বলেন, ‘মিষ্টি জলে, বিশেষত একটু উষ্ণ জলাশয়ে এটা দেখা যায়। তাই মনে রাখতে হবে কেউ যাতে যাতে জলাশয়ের জলে ঝাঁপিয়ে না পড়েন বা ডুব না দেন। এভাবেই কিন্তু ওই অ্যামিবা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে থাকে।’
বিষয়টা আরো বিশদে ব্যাখ্যা করেন ওই চিকিৎসক।
তার কথায়, ‘পানি দূষিত হলে অ্যামিবা নাক দিয়ে মানব শরীরে প্রবেশ করে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি দূষিত জলাশয় থেকে দূরে থাকা যায়। এমন কী সুইমিং পুল থেকেও দূরত্ব রাখা ভালো। অথবা সাঁতারুদের উচিত তাদের মুখ পানির ওপরে রাখা। পানি ক্লোরিন মেশানো খুবই জরুরি।’
তবে কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালুরুর কস্তুরবা মেডিক্যাল কলেজের তরফে প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে নাইজেরিয়া এবং ম্যাঙ্গালুরুর নবজাতকদের মধ্যে নিগলেরিয়া ফওলেরি অ্যামিবা সংক্রমণ সেখানকার পানির উৎসর মাধ্যমে হয়েছে। এক্ষেত্রে গোসলের পানিও এই রোগের উৎস হতে পারে।
যারা বেঁচে গিয়েছেন
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর তরফে পাকিস্তানের একটা বিশেষজ্ঞ দলের একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে এই মগজ খেকো রোগে আক্রান্ত হয়েও বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের বয়স নয় বছর থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
১৯৭১ সালে আফনান জসিমের মতোই অস্ট্রেলিয়ার ১৪ বছরের এক রোগী এই রোগে আক্রান্ত হলেও বেঁচে যান। তার লক্ষণের বিষয়ে তেমন জানা যায়নি।
এই তালিকায় দ্বিতীয় হলো এক নয় বছরের আরেক রোগী, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর বাসিন্দা। তার শরীরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল তিন দিনের মধ্যে।
পরের ঘটনা ২০০৩ সালের। ওই বছর মেক্সিকোর ১৪ বছরের এক রোগীর শরীরে নয় ঘণ্টার মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল।
এই তালিকায় থাকা চতুর্থ ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সেখানে এক ১২ বছরের এক রোগীর শরীরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে লেগেছিল দু’দিন।
২০১৫ সালে পাকিস্তানের যে রোগী এই রোগে আক্রান্ত হয়েও বেঁচে ফিরেছেন, তার ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল তিন দিনে। রোগীর বয়স ছিল ২৫ বছর।
২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ বছরের যে রোগী এই মস্তিষ্ক নষ্ট করে দেয়া অ্যামিবার কবলে পড়ে বেঁচে ফিরতে সক্ষম হয়েছিলেন তার শরীরে রোগের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল মাত্র এক দিনেই।
২০২৩ সালে পাকিস্তানের ২২ বছরের রোগীর ক্ষেত্রে এই সময়সীমা ছিল দু’দিন।
এই তালিকায় নবম ব্যক্তি হলেন ভারতের এই কিশোর।
এর চিকিৎসা কী?
ডা. রউফ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পুরো বিশ্বে পিএএম-এর ৪০০টা ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে। ভারতে এখন পর্যন্ত নথিভুক্ত হয়েছে ৩০টা ঘটনা। কেরালায় ২০১৮ ও ২০২০ সালে একটা করে ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে এবং চলতি বছরে এখন পর্যন্ত পাঁচজন আক্রান্ত হয়েছেন।’
জানা গেছে, আফনান জসিমের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘লাম্বার ট্রিটমেন্ট’ (কটিদেশীয় চিকিৎসা) এবং ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল’ ড্রাগের (ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ইত্যাদি সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ওষুধ) সংমিশ্রণ (অ্যাম্ফোটেরিসিন বি, রিফাম্পিন এবং অ্যাজিথ্রোমাইসিন) ব্যবহার করেছিলেন।
ডা. রউফ বলেন, ‘রোগীর সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুয়িডে এন ফোভালারি শনাক্ত করতে আমরা পিসিআর (পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন) করেছি। আমরা ওকে মিল্টেফোসিন (অ্যামিবা সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ওষুধ) দিয়েছিলাম, যা আগে পাওয়া কঠিন ছিল। এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে থাকলে সরকারের তরফে এই ওষুধ জার্মানি থেকে আমদানি করা শুরু হয়। ভারতে বিরল রোগের চিকিৎসার জন্য এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে এটা কিন্তু খুব একটা ব্যয়বহুল নয়।’
ধীরে ধীরে চিকিৎসায় সাড়া দিতে থাকেন ওই ছাত্র। চিকিৎসক আব্দুল রউফ বলেন, ‘প্রথম দিন খিঁচুনির কারণে রোগী খুব একটা সচেতন অবস্থায় ছিল না। তিন দিনের মধ্যে আফনানের অবস্থার উন্নতি হয়। এক সপ্তাহ পরে, আমরা আবার লাম্বার পাংচারের আশ্রয় নিয়েছি এবং নমুনার ফলাফল নেতিবাচক এসেছিল। আমরা ওকে একটা কক্ষে স্থানান্তর করে চিকিৎসা চালিয়ে যাই।’
আফনান জসিমের ওষুধ আগামী এক মাস চলবে। আপাতত সে বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছে আর আশা করছে দশম শ্রেণীর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার।
কথা বলার সময় ছেলে আফনান সম্পর্কে একটা একটা বিষয় উল্লেখ করেন সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা আফনানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ভবিষ্যতে কী নিয়ে পড়াশোনা করতে চায়। সে চিকিৎসকদের জানিয়েছিল নার্সিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করতে চায়। হাসপাতালে নার্সদের কাজ দেখে খুবই মুগ্ধ আফনান। সে ডাক্তারদের জানায়, রোগীদের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন নার্সরা। তাই ওর এই সিদ্ধান্ত।’
সূত্র : বিবিসি