০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

হিটস্ট্রোকে করণীয়

-

শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কার্যহীনতার ফলে হিটস্ট্রোক বা সর্দি-গরমি/হিটফিভার হয়ে থাকে। এটি একটি জীবন ঝুঁকিপূর্ণ জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যা। স্বাভাবিক অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে চামড়ায় রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালী প্রসারিত হয়। ফলে ঘাম হয়ে শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমে। শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৪১০ (১০৫.৮০ ফারেনহাইট) বা বেশি হলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এত অধিক তাপমাত্রায় শরীরের আমিষ (প্রোটিন) জাতীয় পদার্থ কার্যহীনভাবে পরিবর্তিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহ, যেমন- (ব্রেইন; বিশেষ করে সেরিবেলাম ও সেরিব্রাম), কিডনি, লিভার, রক্তনালীর ঝিল্লি ও মাংসপেশি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশিক্ষণ ধরে অত্যধিক গরম আবহাওয়ার বাইরে কাজ করলে এমনকি শারীরিক ব্যায়াম করলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। শিশু ও বয়স্কদের এ অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের জটিলতা (স্নায়ুবিক অসাড়তা, অটোনোমিক নিউরোপ্যাথি) হলে এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিছু মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ যেমন- ফেনোথিয়াজিন (যেমন- লারগেকটিল, মেলেরিল, মেডিকেট, স্টিমিটিল), বিশ^তার ওষুধ (টিসিএ), এমপিটামিন, বারবিচুরেট সেবনকারী রোগীরও এ ধরনের জটিল অবস্থা হতে পারে।
হিটস্ট্রোকের লক্ষণ : মাথাব্যথা, বমিভাব, বমি হওয়া, দুর্বলতা ও খিটখিটে মেজাজ দিয়ে শুরু হলেও ক্রমে পাগলামি করা, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া, শারীরিক তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যাওয়া ও পরবর্তী সময়ে চোখে ঝাপসা দেখা, অজ্ঞান হওয়া ও খিঁচুনি হওয়া বিচিত্র নয়। প্রথমে চামড়া গরম থাকলেও পরবর্তীতে ঘাম হয়, ঘাম নাও হতে পারে ও ক্রমে চামড়া শুষ্ক হয়ে যায়। রক্তচাপ প্রথমে ভালো থাকলেও পরবর্তীকালে কমে যেতে পারে।
অন্যান্য লক্ষণ : এনকেফালোপেথি, কিডনি বিকল হওয়া, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, অগ্ন্যাশয়, ক্ষুদ্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, ডিআইসি (রক্ত জমাট বাঁধা প্রক্রিয়ায় বাধা)।
রুটিন পরীক্ষা : রক্তে পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম কমে যাওয়া, প্রস্রাবে এ্যালবুমিন ও মায়োগ্লোবিন থাকা, লিভার ও কিডনি ফাংশন টেস্টে পরিবর্তন ও ইসিজিতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। বুকের এক্স-রে করা যেতে পারে।
হিটস্ট্রোকের চিকিৎসা দ্রুততার সাথে শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রতি মিনিটে ০.২০ সে:গ্রে করে কমিয়ে ৩৯০ সে: গ্রে নামানো। দ্রুত রোগীকে ছায়ায় নিয়ে যান। বাষ্পীকরণ পদ্ধতিতে তাপমাত্রা কমানোর সহজ ও কার্যকর উপায় হলো রোগীর শরীরে ন্যূনতম কাপড় রেখে সমস্ত শরীর উষ্ণ গরম পানিতে (১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) মুছে নেয়া ও ফ্যান বা পাখার মাধ্যমে পুরো শরীরে বাতাস করা। রোগীকে একদিকে কাত করে শোয়ানো, যাতে চামড়ায় বেশির ভাগ অংশ বাতাস লাগার জন্য অনাবৃত থাকে।
অনেকে ভুলবশত বরফের পানিতে রোগীকে গোসল করিয়ে দেন। এতে রোগীর কাঁপুনি হয় ও রক্তচাপ কমে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তবে শরীরের বিশেষ অংশ যেমন- হাত ও বগলের নিচে, ঊরুর ভাঁজ বা ঘাড়ে বরফ প্যাক প্রয়োগ করে তাপমাত্রা কমানো যেতে পারে। তবে এ পদ্ধতির চেয়ে উপরে বর্ণিত বাষ্পীকরণ পদ্ধতি অনেক বেশি কার্যকর। এ পদ্ধতিগুলো তাপমাত্রা ৩৯০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে নামা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। ৩০ মিনিটের মধ্যে তাপমাত্রা ৪০০ সে:গ্রে নিচে নামানো প্রয়োজন। রোগীকে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা বাঞ্ছনীয়। জ্বর কামানোর বহুল প্রচলিত ওষুধসমূহ যেমন- প্যারাসিটামল কিংবা ব্যথানাশক সাপোজিটরি ব্যবহারের মাধ্যমে তাপমাত্রা কমানোর কোনো ভূমিকা নেই; বরং হিটস্ট্রোকে এগুলো ব্যবহার না করার নিয়ম আছে।
রোগীকে বিভিন্ন জটিলতার জন্য বারবার পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে আইসিইউতে ভর্তি করানো। পরিমাণ মতো প্রস্রাব হওয়ার জন্য রোগীকে প্রয়োজন মতো পানি দেয়া প্রয়োজন, আইভি স্যালাইন দেয়া, সেই সাথে দেয়া স্যালাইন ও প্রস্রাবের পরিমাণ পরিমাপ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ তাপমাত্রা পরিমাপের থার্মোমিটার আমাদের দেশে না থাকায় অনেক সময় হিটস্ট্রোকের রোগীর তাপমাত্রা নির্ণয়ের অসুবিধা হতে পারে।
গরমের সময় বেশিক্ষণ বাইরে কাজ না করতে বলা আমাদের মতো দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশে কতটুকু কার্যকর হবে বলা কঠিন। তবে তাপমাত্রা বাড়ার প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো শুধরানো যেতে পারে। আমাদের দেশে অত্যধিক জ্বর হয় এমন রোগ যেমন ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ম্যানিনজাইটিস ইত্যাদির কথা মনে রাখতে হবে এসব রোগীর ক্ষেত্রে।
লেখক : মেডিসিন ও সাবেক মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর, ঢাকা।
ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement