০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

তাপদাহ বা হিটওয়েভ এবং করণীয়

-

হিটওয়েভ বা তাপদাহ এমন একটি অবস্থা যখন একনাগাড়ে বেশ কিছু দিন কোনো জায়গায় স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক তাপমাত্রা বিরাজমান থাকে। বৈশ্বিক আবহাওয়া দ্রুত পাল্টাচ্ছে। পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে দ্রুত উষ্ণায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। প্রতি বছর তাপমাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো ঘটনা। বর্তমানে দেশের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অতি তাপপ্রবাহ বা হিটওয়েভ। দেশের তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে যাচ্ছে। যদিও চৈত্র-বৈশাখের এই সময়টিতে গরমের মৌসুম তবে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাওয়া এবং দিনের পর দিন অব্যাহত থাকা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ফলে জনজীবনে দেখা দিচ্ছে চরম অস্বস্তি। তাপমাত্রার সাথে জনজীবনের স্বস্তি বা অস্বস্তি কেন? বিষয়টি বুঝতে হলে মানবদেহ কিভাবে তাপমাত্রার সাথে জড়িয়ে আছে বিষয়টি একটু অনুধাবন করা প্রয়োজন।
প্রতিটি প্রাণীর মতো মানবদেহ একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সচল থাকে। এর ব্যত্যয় হলে দেহ অচল হয়ে পড়ে। দেহের বাইরে বা পরিবেশে তাপমাত্রা যাই থাকুক মানবদেহের অভ্যন্তরভাগে তাপমাত্রা সবসময় নির্দিষ্ট একটি গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে। সাধারণত ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলো এর গণ্ডি। এর থেকে সামান্য এদিক সেদিক হলেই বিপর্যয়। যেমনটি আমরা জ্বরের সময় অনুভব করি। জ্বরের সময় দেহের অভ্যন্তরস্থ তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ফলে স্বাভাবিক জীবন অচল হয়ে পড়ে। জ্বর বেশি হলে তখন মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং মৃত্যুও হতে পারে।
মানবদেহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের অভ্যন্তরস্থ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মস্তিষ্কে তাপমাত্রার খবরদারির জন্য হাইপোথেলামাস নামক একটি সেন্সর বসানো আছে। হাইপোথেলামাসের কাজ হলো কোনো কারণে দেহের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তাৎক্ষণিক দেহ থেকে অতিরিক্ত তাপ বের করে দিতে সঙ্কেত দিয়ে থাকে। দেহে তখন প্রচুর ঘাম হয়। ঘাম দেহ থেকে তাপমাত্রা শোষণ করে বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে বিলীন হয়ে যায়। আবার যখন পরিবেশে তাপমাত্রা কমে যায় তখন সে ত্বকের রক্তনালীর সঙ্কোচনের মাধ্যমে তাপ সংরক্ষণ করে। এভাবে দেহ একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে নিজ তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে থাকে।
দেহের অভ্যন্তরে তাপের প্রধানতম উৎস হলো মেটাবলিজম বা খাবারের পরিপাকপ্রনালী; ইনফেকশন ও কায়িক শ্রম। এ ছাড়া বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। দেহের অভ্যন্তরস্থ বা দেহের বাইরে পরিবেশের তাপমাত্রায় সব সময় কিছুটা তারতম্য হতে পারে এবং সীমিত তারতম্যে দেহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু এই তারতম্য মাত্রাতিরিক্ত হলে তখন দেহ এটিকে আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামাল দিতে পারে না। তখনই বিপত্তি দেখা দেয়।
তাপদাহে দেহে যে পরিবর্তনগুলো দেখা দেয় তার মধ্যে প্রাথমিকভাবে প্রচুর ঘামের ফলে দেহ থেকে জলীয় অংশ বের হয়ে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। একই সাথে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। বমিভাব, মাথা ঘুরানো, মাথা ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। দেহে ক্লান্তি অনুভূত হয়। অনেক সময় পেশিতে খিল ধরে যায় (মাসল ক্র্যাম্প)। বেশ পিপাশা পায়। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বেশ পানি খেতে গিয়ে বিশুদ্ধ পানির অভাবে সাধারণ পানি পান করতে গিয়ে অনেকই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়। ফলে দ্রুত অবস্থার অবনতি হতে দেখা যায়। এমন অবস্থায় জরুরি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ব্যবস্থা না নিলে জীবন সংশয় দেখা দিতে পারে। অনেক সময় ত্বকে ফোসকা পড়ে অথবা পা ফুলে যায়। অতি তাপদাহে এক সময় দেহ আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে কুলিয়ে উঠতে পারে না। ঘামের মাধ্যমে তাপ দেহ থেকে বের হয়ে দেহকে ঠাণ্ডা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন দেহে দ্রুত তাপমাত্রা বেড়ে যায়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এটিকে বলা হয় হিটস্ট্রোক।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন। রোদে প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়া, সম্ভব হলে ছায়ায় বা ঘরে অবস্থান করা, প্রচুর পানি পান করা, ঢিলেঢালা পোশাক ব্যবহার করা, সহজে হজম হয় এমন খাবার গ্রহণ করা, বাসি খাবার থেকে বিরত থাকা, তৈলাক্ত খাবার যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে এবং শাকসবজি বেশি পরিমাণে খেতে হবে। এই সময়ে ডাবের পানি, তরমুজ, শসা শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণে বেশ সহায়ক। অন্য দিকে গরুর গোশত, গ্রিন টি, ওটস, পরিহার করা উত্তম। শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থদের পক্ষে যথাসম্ভব কায়িক পরিশ্রম এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। অসুস্থবোধ করলে ঘরে ফেনের নিচে অথবা সুযোগ থাকলে এয়ার কন্ডিশনে থাকার চেষ্টা করতে হবে। বেশি খারাপ বোধ করলে হাসপাতালে যেতে হবে। তাপদাহের এই সময়টিতে সতর্ক থাকুন ও নিরাপদে থাকুন।
এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমএস (চক্ষু)
সহযোগী অধ্যাপক চক্ষু/
কনসাল্টেন্ট- আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার
৩৮/৩-৪ রিং রোড, আদাবর, ঢাকা।
০১৯২০৯৬২৫১২


আরো সংবাদ



premium cement