২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১, ২৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস

আর নয় বিষপান

আর নয় বিষপান -

বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের আড়াই কোটিই ধূমপায়ী। জর্দা, তামাক পাতা, গুল হিসেবে আনলে এ সংখ্যা চার কোটি ১৩ লাখ। উন্নত দেশগুলোতে সেখানে তামাক সেবন কমছে সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাক সেবন ৩.৪ শতাংশ হারে প্রতি বছর বাড়ছে। ধূমপানের কারণে অকালেই ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ১৯৮৭ সাল থেকে ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে বিশ্বকে ধূমপানমুক্ত করার অদম্য প্রচেষ্টা করে চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় পালিত হচ্ছে ৩১ মে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’।

ধূমপানে স্বাস্থ্য ক্ষতি :
শুধু ধূমপানের কারণেই আয়ুষ্কাল কমে যায় ১০-২০ বছর। বিশ্বে যত লোক মারা যায়, তার দ্বিতীয় প্রধান কারণ ধূমপান। প্রতি বছর ৫৮ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় ধূমপানের কারণে, প্রতি ১০ জনে একজন। মৃতদের ৭০ শতাংশই কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এর অবস্থা দাঁড়াবে ছয়জনের মধ্যে একজন। হু-এর মতে, প্রতি বছর এক কোটি লোক ধূমপানের কারণে অসুস্থ হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ধূমপানের কারণে বিংশ শতাব্দীতে যে পরিমাণ মারা গেছে, একবিংশ শতাব্দীতে তার ১০ গুণ মারা যাবে। সিগারেটের একটা টানে তিন হাজারেরও অধিক রকম রাসায়নিক পদার্থ ঢুকে যায় ধূমপায়ীর শরীরে। এর মধ্যে প্রধান হলো নিকোটিন। এই নিকোটিনই ধূমপান ছাড়তে দেয় না। এমন কোনো রোগ নেই যার কারণের মধ্যে ধূমপান নেই। তবে ধূমপানের কারণে সবচেয়ে ভয়াবহ রোগীটি হলো ক্যান্সার। সিগারেট-বিড়িতে ৬৫ রকমের বেশি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৩ শতাংশের ক্যান্সারের কারণ ধূমপান। ধূমপানের ফলে সবচেয়ে বেশি হয় ফুসফুসের ক্যান্সার। প্রতি বছর বিশ্বে ১৩ লাখ লোক মারা যায় ফুসফুসের ক্যান্সারে, বাংলাদেশে মোট ক্যান্সার রোগীর ২৫ শতাংশ। এ ক্যান্সারের ৯০ শতাংশ কারণ ধূমপান। এ কারণে হতে পারে মুখ, গলা, গলবিল, খাদ্যনালী, অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী, যকৃত, মুত্রথলি, বৃহদান্ত্র ও মলাশয়, স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার। গবেষণায় দেখা গেছে, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা দশগুণ এবং মুখ, গলা, অন্ননালী, অগ্নাশয়, কিডনি, মুত্রথলি, জরায়ু মুখ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কয়েকগুণ বেশি। এ ছাড়াও ধূমপান করলে রক্তে মোট কোলেস্টেরল ও খারাপ কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা বেড়ে যায় এবং কমে যায় ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএলের মাত্রা। এতে রক্তনালীতে চর্বি জমে গিয়ে হতে পারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, পায়ে গ্যাংগ্রিন। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের ৪০ বছরের পর হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা পাঁচগুণ বাড়ে। হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা অধূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ। ধূমপানের কারণে হতে পারে সিওপিডি-এমফাইসেমা, ক্রোনিক ব্রঙ্কাইটিস। শ্বাসনালীর ইনফেকশনও বাড়ায় ধূমপান। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের যক্ষ্মা হওয়ার সম্ভাবনা দুই থেকে চারগুণ বেশি। প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয় এরা। এ ছাড়াও ঘন ঘন ফুসফুসের ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়। ধূমপানের ফলে মায়ের পেটের শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গর্ভাবস্থায় ধূমপান করলে অ্যাবরশন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। শিশুর ওজন কম হতে পারে, আক্রান্ত হতে পারে অ্যাজমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু মা-বাবার ধূমপানের আমেরিকার দুই-তিন লাখ শিশু শ্বাসনালীর প্রদাহে আক্রান্ত হয়ে ১৫ হাজার হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ ছাড়াও কোনো কারণ ছাড়াই মারা যেতে পারে শিশু। আপনি হয়তো বা ধূমপান করেন না। ভাবতে পারেন আপনি এ স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে মুক্ত। আপনার আশপাশের ধূমপায়ীদের ধোঁয়া আপনার ক্ষতি করে চলেছে আপনার অগোচরে। একে বলে সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং। গবেষণায় দেখা গেছে, ফুসফুসের ক্যান্সারের ১০ ভাগ রোগী কখনোই ধূমপান করেননি। এরা আক্রান্ত হয়েছেন সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং থেকে। এ ছাড়াও এদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁঁকি ২০-৩০ শতাংশ, হৃদরোগের ঝুঁকি ২০-৩০ শতাংশ। তাই আপনার আশপাশের ধূমপায়ী হতে সাবধান হোন।

অর্থনৈতিক ক্ষতি :
দেশে প্রতিদিন একজন ধূমপায়ী কমপক্ষে পাঁচটি সিগারেট টানেন। মাসিক তার খরচ হয় ৪০০ টাকার বেশি। আমাদের মোট জিডিপির প্রায় দেড় ভাগই ক্ষয় হয় সিগারেট-বিড়ির পেছনে। বিশ্বে সর্বোচ্চ বিড়ি-সিগারেট উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ২০ নম্বরে বাংলাদেশ।
শুধু সিগারেটের আগুনে জ্বলে বিশ্বব্যাপী ৪০ হাজার কোটি ডলার পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে উন্নয়নশীল দেশ থেকে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষরা তাদের আয়ের ১০ শতাংশের বেশি খরচ করে ধূমপানের পেছনে। এ কারণে এরা খাদ্য, বস্ত্র, বসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদায় জোগান দেয়ার মতো অর্থ থাকে না। পরিবারের সদস্যরা অপুষ্টিতে ভোগে। ধূমপায়ীরা বেশির ভাগ সময়ই বিভিন্ন রোগে অসুস্থ থাকে। ফলে তাদের আয় করার ক্ষমতা কমে যায়। এদের অসুখের জন্য বেড়ে যায় পরিবারের চিকিৎসা খরচ।

ধূমপান বন্ধ করার সুফল :
- ২০ মিনিট পর ধূমপায়ীর রক্তচাপ, নাড়ির গতি এবং দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
- আট ঘণ্টার মধ্যে ধূমপায়ীর রক্তের কার্বন-মনোঅক্সাইডের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
- তিন দিনের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
- শ্বাসকষ্ট এবং সিওপিডি অনেক ভালো হয়ে যাবে।
- এক বছর পর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ কমে যাবে এবং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাবে।
- ১০ বছর পর হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা এতটাই কমে যাবে তা অধূমপায়ীদের মতো হয়ে যাবে।
- ধূমপানের কারণে যে অর্থ খরচ হয় সে অর্থ জমিয়ে অনেক প্রয়োজনীয় ভালো কাজ করা যেতে পারে।
ধূমপান ভালো কিছু বয়ে আনে না। নিয়ে আসে রোগ-বালাই, অশান্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি। শুধু সাময়িক মানসিক প্রশান্তির আশায় আমরা ধ্বংস করে দিচ্ছি নিজেদের। পরিবারকে ঠেলে দিচ্ছি ঝুঁকির মধ্যে, অভিভাবকহীনতার নিরাপত্তহীনতায়। আসুন আজ আপনার নিষ্পাপ শিশুসন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রতিজ্ঞা করি ‘ধূমপান আর নয়’।

 


আরো সংবাদ



premium cement