২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১, ২৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

আপনার চোখ পরীক্ষা করুন

আপনার চোখ পরীক্ষা করুন -

১০ অক্টোবর ২০১৩ বিশ্বব্যাপী পালন করা হলো বিশ্ব দৃষ্টি দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব প্রিভেনশন অব ব্লাইন্ডনেসের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করা হয়। এ বছর এই দিবসের উদ্দেশ্য ছিল ইউনিভার্সাল আই হেলথ বা সর্বজনীন চক্ষু চিকিৎসা সেবা। এ বছর এই বিশ্ব দৃষ্টি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘গেট ইউর আইজ টেস্টেড’ বা ‘আপনার চোখ পরীক্ষা করুন।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অ্যাকশন প্লানে রয়েছে প্রিভেনশন অব অ্যাভয়েডঅ্যাবল ব্লাইন্ডনেস বা পরিহারজনিত অন্ধত্বের প্রতিরোধ করা। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পরিহারজনিত অন্ধত্বের মধ্যে রয়েছে চোখের ছানি, গ্লকোমা, কর্নিয়া অন্ধত্ব, ডায়াবেটিস ও বয়সজনিত অন্ধত্ব।

চোখের ছানি
বর্তমান বিশ্বে অন্ধত্বের মূল কারণ হচ্ছে চোখের ছানি এবং এর জটিলতা। বাংলাদেশেও অন্ধত্বের প্রধান কারণ ছানি। চোখের লেন্স বা এই লেন্সের আবরণ ঘোলা হয়ে যাওয়াকে ছানি বা ক্যাটারাক্ট বলা হয়। সাধারণত ৬০-৮০ বছর বয়সেই ছানি পড়তে দেখা যায়। তবে চোখের আঘাত, চোখের বিভিন্ন প্রদাহ ইত্যাদি নানা কারণে যেকোনো সময় এবং যেকোনো বয়সে চোখের ছানি পড়তে পারে। ডায়াবেটিস ও শারীরিক কিছু অসুখে অতি অল্প বয়সেও চোখের ছানি হতে পারে।
চোখের ছানির আধুনিক চিকিৎসা: ছানির একমাত্র চিকিৎসা অপারেশন। তবে অপারেশনের মধ্যে নানারকম পদ্ধতি রয়েছে। প্রাচীনকালে কাউচিং পদ্ধতিতে চোখের ঘোলা লেন্স বা ছানিকে চোখের জলীয় পদার্থ ভিট্রিয়াসের মধ্যে ফেলে দেয়া হতো। এতে রোগীরা হয়তো এক হাতের মধ্যে কিছু কিছু দেখতে পেতেন।
পরবর্তীতে ছানি অপারেশনের পর যাতে স্বাভাবিক দেখা যায় তার জন্য যুগান্তকারী অপারেশন ইন্ট্রাঅকুলার লেন্স (ওঙখ) ইমপ্লান্ট শুরু হলো। ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ডে ডা: হ্যারল্ড রিডলি প্রথমে চোখের ছানি ফেলে দিয়ে সেখানে প্লাস্টিকের তৈরি কৃত্রিম লেন্স বসিয়ে দেন। পরবর্তীতে অনেক গবেষণার পর আইওএলের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে কয়েক শ’ চক্ষু বিশেষজ্ঞ আইওএল ইমপ্লান্ট অপারেশনে পারদর্শী। বর্তমান যুগে অপারেশনে আরো ভালো দেখার জন্য করা হচ্ছে ফ্যাকো সার্জারি। চোখের লেন্সকে আল্ট্রাসনিক শক্তির সাহায্যে গলিয়ে বের করে আনার নাম হচ্ছে ফ্যাকো ইমালসিফিকেশন সংক্ষেপে ফ্যাকো সার্জারি। ফ্যাকো মেশিনের সাহায্যে চোখের লেন্সকে গলিয়ে নরম করে বের করে আনা হয়। এই পদ্ধতিতে সাধারণ ছানি অপারেশনের মতো চোখের প্রায় অর্ধেক কাটার প্রয়োজন হয় না। চোখের পাশে ছোট একটি ছিদ্র করে ওই মেশিনের সাহায্যে ছানিকে ইমালছিফাই করা হয় বা গলিয়ে আনা হয়। আবার ওই একই পথ দিয়ে ভাঁজ করা যায় বা ফোল্ডঅ্যাবল নরম কৃত্রিম লেন্স বসানো হয়। ওই ছিদ্রপথে সাধারণত কোনো সেলাইয়ের প্রয়োজন হয় না।

চোখের গ্লকোমা রোগ
সারা বিশ্বে অন্ধত্বের একটি প্রধান কারণ হলো গ্লকোমা। এ রোগটি উন্নত এবং উন্নয়নশীল সব দেশেই প্রায় সমানভাবে বিস্তৃত। বাংলাদেশে এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে গ্লকোমা বাংলাদেশে অন্ধত্বের তৃতীয় প্রধান কারণ। চল্লিশোর্ধ বয়সের নারী-পুরুষের শতকরা প্রায় তিনজন এ রোগে ভুগে থাকে। অথচ এটি কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি নয়। এ রোগের চিকিৎসা আছে। রোগটির উপসর্গ ও লক্ষণ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা গেলে খুব সামান্য ওষুধেই রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং প্রয়োজনবোধে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন করলে স্থায়ীভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব। অথচ চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হলে পরিণতি হলো অন্ধত্ব।
গ্লকোমাজনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধ করার জন্য দরকার সতর্ক সচেতনতা। প্রাথমিক অবস্থায় গ্লকোমা নির্ণয় করে এর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ওষুধ, লেজার বা সার্জারি করলে গ্লকোমা অন্ধত্বের হার ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে।
চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ ১০ মিমি মারকারি থেকে ২১ মিমি মারকারি পর্যন্ত। এই চাপ কোনো কারণে বেড়ে গেলে চোখের (অপটিক) নার্ভ ও অন্যান্য অংশের ক্ষতিসাধন করে, দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়, বিশেষ করে দৃষ্টির পরিসীমার পরিবর্তন হয়। চোখের এই অবস্থার নামই গ্লকোমা।
গ্লকোমা রোগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : অনেক সময় এ রোগে কোনো উপসর্গ ছাড়াই মারাত্মক দৃষ্টিস্বল্পতা এমনকি চোখ অন্ধও হয়ে যেতে পারে, রোগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপসর্গের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই চোখ অন্ধ হতে পারে, অনেক শিশু এই রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে, এক ধরনের গ্লকোমাতে চোখ লাল হয় এবং প্রাথমিক অবস্থায় তেমন রোগে অসুবিধা না হওয়ায় রোগীরা সাধারণ চোখ ওঠা মনে করে ভালো চিকিৎসা করায় না, এর ফলেও গ্লকোমা রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব ঘটে। রোগের উৎপত্তি এবং কারণ অনুযায়ী গ্লকোমাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। তবে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাথমিক গ্লকোমা ও সেকেন্ডারি গ্লকোমা।
প্রাথমিক গ্লকোমা : এই ধরনের গ্লকোমা চোখের সামনের চেম্বারের রোগে বিকাশগত ত্র“টির জন্য হয়ে থাকে। সাধারণত দুই চোখই প্রাথমিক গ্লকোমায় আক্রান্ত হয়। ৩৫ বছর বয়সের পরে নারী বা পুরুষ উভয়েরই এই ধরনের গ্লকোমা হতে পারে। এই রোগ সাধারণত বংশানুক্রমিক হয়ে থাকে। চোখের অ্যাকুয়াস হিউমার বেরিয়ে যাওয়ার পথে অর্থাৎ সামনের চেম্বারের কোণে, রোগে কোনো কারণে বাধা সৃষ্টি হলে যদি চোখের চাপ বেড়ে যায় তবে তাকে প্রাথমিক গ্লকোমা বলা হয়। এখানে চোখের বা শরীরের অন্য রোগে কোনো রোগের সঙ্গে চাপ বাড়ার সম্পর্ক থাকে না। প্রাথমিক গ্লকোমাকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ১. জন্মগত গ্লকোমা ২. প্রাথমিক অ্যাঙ্গেল খোলা গ্লকোমা ৩. প্রাথমিক অ্যাঙ্গেল বন্ধ গ্লকোমা।

সেকেন্ডারি গ্লকোমার সাধারণ কারণগুলো
- চোখে আঘাতজনিত কারণে,
- চোখের ইউভিয়াইটিজ, স্কে¬রাইটিজ ইত্যাদির জটিলতা হিসেবে,
- চোখের ভেতরে রক্তক্ষরণ হলে,
- চোখের লেন্স ফুলে গেলে, যেমন ছানির প্রাথমিক পর্যায়ে,
- লেন্সের স্থানচ্যুতি হলে,
- ছানি বেশি পেকে গেলে,
- চোখের ছানির অস্ত্রোপচারের জটিলতা হিসেবে,
- চোখের ভেতর কোনো টিউমার হলে,
- চোখে নতুন ধমনি বা শিরা তৈরি হয়ে অ্যাঙ্গেল বন্ধ করলে,
- কেন্দ্রীয় রেটিনাল ভেন বন্ধ হয়ে গেলে,
- কোনো কোনো ওষুধ যেমন স্টেরয়েড, এট্রপিনজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করলে,
এই ধরনের গ্লকোমার কারণ দূর করতে পারলে এই রোগ ভালো হয়ে যাওয়ার খুব সম্ভাবনা থাকে।

গ্লকোমা প্রতিরোধ করার উপায়
গ্লকোমা প্রতিরোধের প্রধান শর্ত হলো এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞসহ সব সাধারণ চিকিৎসকের এ রোগ নির্ণয়ে অংশগ্রহণ। আর এ দুটো বিষয়কে সুষ্ঠুভাবে কার্যকরী করার জন্য সমাজের শিক্ষিত সচেতন ব্যক্তি এবং চিকিৎসক সমাজকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সব প্রচারমাধ্যমে (সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন) সাধারণ মানুষের জন্য সহজ সাবলীল ভাষায় এবং অবশ্যই মাতৃভাষায় এ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রচার করতে হবে এবং এ কাজে চক্ষু বিশেষজ্ঞদের এগিয়ে আসতে হবে।
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গ্রামেগঞ্জে চক্ষু শিবির করে যখন চোখের ছানি অপারেশন করেন তখন সম্ভাব্য রোগীদের (পঁয়ত্রিশোর্ধ নারী-পুরুষ) গ্লকোমা স্ক্রিনিং টেস্ট করা যেতে পারে। এতে সহজে সরাসরি রোগনির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক জনগণের মধ্যে এ রোগটি সম্পর্কে একটা সচেতনতাও সৃষ্টি হবে।
সাধারণ চিকিৎসকদের (জেনারেল প্র্যাকটিশনার্স) জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা যায়। ফলে এ রোগনির্ণয়ের বিভিন্ন আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো সম্বন্ধে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে এ রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে। যেহেতু আমাদের দেশে চক্ষু বিশেষজ্ঞের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম তাই সাধারণ চিকিৎসকদের এ বিষয়ে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে।
গ্লকোমা রোগীও এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি তার রোগ ও চিকিৎসার অভিজ্ঞতা তার আশপাশের লোকজনকে জানালে তারা সহজেই রোগটি সম্পর্কে সচেতন হতে পারবেন এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা করিয়ে চোখকে অন্ধত্বের হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন। এ ছাড়া ৩৫ বছর বয়সের পর বছরে একবার চোখের চাপ নির্ণয়সহ সম্পূর্ণ চক্ষু পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এটা সবাই উপলব্ধি করলে গ্লকোমা রোগটি প্রতিরোধ সহজতর হবে।

ডায়াবেটিসে চোখের অন্ধত্ব
ডায়াবেটিস যদি অনেকদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকে তাহলে চোখে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। সঠিক চিকিৎসা ও লেজার না করা থাকলে চোখে রক্তক্ষরণ হয়, চোখের রক্তনালী বন্ধ হয়, রেটিনায় রক্তশূন্যতার সৃষ্টি হয়। এসব কারণে রেটিনায় নতুন নতুন রক্তনালী তৈরি হয়। এই অবস্থাকে বলা হয় প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। পিডিআর অবস্থায় লেজার চিকিৎসা না করলে চোখের রেটিনার ওপরে এবং ভিট্রিয়াসের মধ্যে রক্তক্ষরণ হয়, রেটিনার ট্রাকশনাল ডিটাচমেন্ট তৈরি হয় এবং চোখের কোণে নতুন রক্তনালী তৈরি হয়ে নিওভাসকুলার গ্লকোমা হয় অর্থাৎ চোখের চাপ অনেক বেড়ে যায় ও অপটিক নার্ভের ক্ষতি হয়।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে অপটিক নার্ভের ও রক্ত সরবরাহ কমে যায় এবং ইসকেমিক অপটিক নিউরোপ্যাথি হতে পারে।
লেজারের সাহায্যে এবং ভিট্রেকটমি অপারেশন সময়মতো করতে পারলে এসব জটিলতা তথা অন্ধত্ব প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিশ্ব দৃষ্টি দিবসের স্লোগানের সাথে বলবো সময় মতো আপনার চোখ পরীক্ষা করান এবং সব পরিহারযোগ্য অন্ধত্ব প্রতিরোধ করুন।
ফ্যাকো ও গ্লকোমা বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ আই হসপিটাল, ঢাকা।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement