২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ডেঙ্গু জ্বর

সচেতনতা ও প্রতিরোধই সংক্রমণ, জটিলতা এবং মৃত্যুঝুঁকি কমাতে পারে
ডেঙ্গু জ্বর -

ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু জ্বর কী?

ডেঙ্গুজ্বর এডিস মশা বাহিত ভাইরাস জ্বর। তবে ডেঙ্গুজ্বরকে সাধারণ ভাইরাস জ্বর মনে করা ঠিক নয়। কারণ এর জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি সাধারণ ভাইরাস জ্বর থেকে অনেক বেশি। ডেঙ্গুর প্রকোপ গরম ও বর্ষাকালে জুলাই থেকে অক্টোবরে সবচেয়ে বেশি থাকে।

ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ
ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার কামড়ে সাধারণত দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।
- জ্বর ডেঙ্গুর প্রধান উপসর্গ। ১০২ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে আবার ঘাম দিয়ে ছেড়ে আবারও আসতে পারে। জ্বর প্রথম দুই-চারদিন খুব বেশি থাকে তারপর কমতে থাকে। কিন্তু বেশির ভাগ রোগীর এ সময়ই জটিলতা দেখা দেয়। যদিও কারো ক্ষেত্রে শুরু থেকেই জটিল অবস্থা প্রকাশ পেতে পারে। যেহেতু জ্বর থাকে না তাই অধিকাংশ রোগী এ অবস্থা অগ্রাহ্য করে। তাই এদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যু মুখে পতিত হয়।
- শরীর ব্যথা বিশেষ করে মাথাব্যথা, পিঠে ব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা
- শরীরে লালচে দাগ
- এছাড়াও খাবার অরুচি, বমি ভাব, ঠাণ্ডা, কাশি ইত্যাদি হতে পারে।

রোগ নির্ণয়
সাধারণত রক্তের ডেঙ্গু এনএস১ ও এন্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু এ পরীক্ষা নেগেটিভ থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে। অভিজ্ঞ ডাক্তার মূলত রোগীর লক্ষণ ও কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) পরীক্ষার সাহায্য নিয়ে ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় ও এর তীব্রতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারেন ।
কখন হাসপাতালে যাবেন?
অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী বাসায় চিকিৎসাযোগ্য। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন হতে পারে।

নিচের যে কোনো একটি থাকলে সাথে সাথে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করবেন বা হাসপাতালে ভর্তি হবেন :
- বারবার বমি বা পাতলা পায়খানা (২৪ ঘণ্টায় ৩ বারের বেশি)।
- ৬ ঘণ্টা পরপর প্রস্রাব না হওয়া।
- একটানা পেটে ব্যথা এবং পেট ফুলতে থাকা
- শরীরের কোথাও থেকে রক্তক্ষরণ
- অতি দুর্বল, অতি অস্থিরতা, শ্বাসকষ্ঠ
- একটানা হাত-পা ঠাণ্ডা, ফ্যাকাসে ভাব, বুকে ব্যথা
- জন্ডিস, খিঁচুনি, অর্ধ অচেতন বা বেহুঁশ
- পর্যাপ্ত পানি জাতীয় খাবার খেতে না পারলে
- অত্যধিক পানি পিপাসা
- প্রেগন্যান্সি, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস বা প্রেসার, কিডনি, লিভার, হার্ট বা ফুসফুসের রোগ ।
- ১ বছরের কম শিশু বা বৃদ্ধ রোগী

ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ও খাবার
- পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকবেন।
- পানি জাতীয় খাবার বেশি পান করবেন : পানি, ওরাল স্যালাইন, লেবুর শরবত, ফলের রস, ডাবের পানি, স্যুপ, দুধ, চিরার পানি, ডালের পানি, তরকারি বা মাছ, গোশতের ঝোল।
- সব খাবার খাবেন বিশেষ করে নরম তরল (জাউ ভাত, সুজি, সাগু, পাতলা খিচুড়ি, পুডিং, ফিরনি, পায়েস, সেমাই, দই, চিড়া ইত্যাদি)
- প্রোটিন জাতীয় খাবার : মাছ, গোশত, দুধ, ডিম।
- জ্বর কমাতে কুসুম গরম পানিতে ভেজানো কাপড় দিয়ে সারা শরীর মুছে দেবেন বা গোসল করবেন। প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ খাবেন।
কী করবেন না?
- কোনো ব্যথাজাতীয় (যেমন অ্যাসপিরিন) ওষুধ খাবেন না। কারণ এতে রক্তক্ষরণ বাড়তে পারে।
- পেঁপেপাতার জুস খাওয়ার দরকার নেই। কারণ ডেঙ্গুতে এর উপকারিতা প্রমাণিত নয়।
- রক্তের কণিকা প্লাটিলেট কমে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কারণ প্লাটিলেট কমে গেলে অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই রক্তক্ষরণ হওয়ার যে ভয় তা দেখা যায় না। সঙ্কটকাল পেরিয়ে গেলে প্লাটিলেট এমনিই বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণ করতে হবে।
- ডেঙ্গু রোগী কোনো এন্টিবায়োটিক নেবে না।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ
- মশার বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধানতম উপায়। এর মধ্যে রয়েছে মশার লার্ভা এবং মশা ধ্বংস করা। এক্ষেত্রে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের আরো গুরুত্ব দেয়া কর্তব্য। ড্রেন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নত স্থায়ী সমাধান এবং নিয়মিত মশা নিধন কার্যক্রম ডেঙ্গুমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম।
- এডিস মশা সাধারণত বদ্ধ পরিষ্কার পানিতে বৃদ্ধি পায়। আপনার আঙিনার কোথাও পানি জমতে দেবেন না।
- আপনার ঘর/বাড়ির আশপাশে কোনো জায়গায় জমে থাকা পানি তিন দিন পর ফেলে দিন ।
- ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, কমোড, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, বালতি, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা/নারিকেলের মালা, কন্টেইনার, পানির মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন/ চিপসের প্যাকেট, এসি বা ফ্রিজের নিচে ইত্যাদি পাত্রে পানি জমে থাকতে পারে।
- পরিত্যক্ত পাত্র উল্টে রাখুন ।
- পানি ফেলে দেওয়ার পর পাত্রটি অবশ্যই পরিষ্কার করে নেবেন।
- অপ্রয়োজনীয় ও পরিত্যক্ত পানির পাত্র নষ্ট করে ফেলুন।
- বর্ষাকালে ছাদ বাগানের কোনো টবে যেন পানি জমতে না পারে তা নিশ্চিত করুন। নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের গর্তে পানি জমে মশার বংশবিস্তার করে; লিফট স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত এই গর্ত বালি দিয়ে ভরাট করে রাখুন।
- ওয়াসার পানির মিটারে জমে থাকা পানিতে মশা ডিম পেড়ে বংশবিস্তার করে, পানির মিটারে মাসে একবার নোভালিউরোন ট্যাবলেট প্রয়োগ করুন।
- নোভালিউরোন ট্যাবলেটের জন্য সংশ্লিষ্ট মশক কর্মীর সাথে যোগাযোগ করলে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়।
- দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে, শিশুদের ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টাঙ্গিয়ে দেবেন।
- এডিস মশা শরীরের খোলা জায়গায় কামড়ায়, তাই যতদূর সম্ভব সমস্ত শরীর ঢাকা থাকে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে।
- প্রয়োজনে শরীরের অনাবৃত স্থানে মশা নিরোধক ক্রিম/লোশন ব্যবহার করুন (মুখমণ্ডল ব্যতীত)।
- নির্ভরযোগ্য সংস্থার সার্টিফাইড মশার কয়েল বা স্প্রে দিতে পারেন।
- সম্ভব হলে জানালা এবং দরজায় মশা প্রতিরোধক নেট লাগাতে হবে যাতে ঘরে মশা প্রবেশ করতে না পারে।
- বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, তাই এ সময় অধিক সতর্কতা অবলম্বন করুন ।
- নিজের সুস্থতার জন্য আপনার আশপাশের অন্যদের সচেতন করুন।
- কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে নিকটস্থ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে/মাতৃসদন থেকে বিনামূল্যে বা পার্শ্ববর্তী ভালো মেডিকেল ল্যাব থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নিন এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন অ্যান্ড হসপিটাল, উত্তরা, ঢাকা। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ইবনে সিনা, উত্তরা, ঢাকা । ফোন : ০১৭৮৬০০৫৭৭৫ডেঙ্গু জ্বর
সচেতনতা ও প্রতিরোধই সংক্রমণ, জটিলতা এবং মৃত্যুঝুঁকি কমাতে পারে


আরো সংবাদ



premium cement