ফরাসি ফুটবলে মুসলিমদের অবদান
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৯ অক্টোবর ২০২০, ১৯:২১
বিশ্বকাপ ফুটবলের যাত্রা শুরু সেই ১৯৩০ সালে। প্রথম আসরেই খেলেছিল ফ্রান্স। পরের আসরে শেষ ষোলো থেকে বিদায়। এরপর ১৯৫৮ সালে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল তৃতীয় স্থান। ১৯৮৬তেও তাই। ফাইনালে উঠাই হচ্ছিল না ফরাসিদের। ঘরের মাঠে ১৯৯৮ সালে স্বপ্ন পূরণ হয় দলটির। প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেই বাজিমাত করে ফ্রান্স শিবির। হয় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ২০০২ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে বাদ গেলেও ২০০৬ বিশ্বকাপে রানার্স আপ। জিদান ঢুঁস না দিলে হয়তো সেবারই বিশ্বকাপ জিততো দলটি। এরপর দীর্ঘ বিরতি, ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে আবার চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স।
হঠাৎ করে বিশ্বকাপ ফুটবলে ফ্রান্সের এই খতিয়ান দেয়ার কারণ কী? কারণ আছে। যে দুইবার ফ্রান্স বিশ্বকাপ জিতেছে, দুইবারই বিশ্বজয়ের ক্ষেত্রে ফ্রান্সের মুসলিম ফুটবলারদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের স্কোয়াডে মুসলিম ফুটবলারদের সংখ্যাটা কম হলেও বিশ বছর পর সে সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। রাশিয়া বিশ্বকাপ জয়ের বছর ফ্রান্স স্কোয়াডে ছিল সাতজন মুসলিম ফুটবলার। এখনো বেশকজন মুসলিম ফুটবলার দাপটের সাথে খেলে যাচ্ছেন ফ্রান্সের জাতীয় দল ও নামিদামি ক্লাবে।
জিনেদিন জিদান
১৯৯৮ বিশ্বকাপের কথা বলতে গেলে চলে আসে জিনেদিন জিদানের নাম। যিনি এখন জীবন্ত কিংবদন্তী। তার হাত ধরেই ফ্রান্স জিতেছিল প্রথম বিশ্বকাপ। জিদান আলজেরীয় বংশোদ্ভুত মুসলিম। নজড় কাড়া পারফরম্যান্সে ফ্রান্সের জাতীয় ফুটবল দলে জায়গা করে নেন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে শক্তিশালী ব্রাজিলের বিরুদ্ধে দুই গোল করে প্রথবারের ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ এনে দেন। তিনি শুধু ফ্রান্সই নন, সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন। খেলোয়াড় হিসাবে জিদান যতটা তার চেয়েও যেন বেশি সফল কোচ। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে শিরোপা জয়ে রেকর্ডই গড়ে চলেছেন তিনি।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের আগে ফ্রান্সের কট্টর রক্ষণশীল নেতা জাঁ ম্যারি লে'পেঁ আলজেরিয়ান বংশদ্ভূত জিনেদিন জিদানসহ দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি দাবি করেন, ওই দলের খেলোয়াড়দের অনেকেই ‘বিদেশী এবং ম্যাচের আগে জাতীয় সঙ্গীত গায় না’। বিশ্বকাপ জেতার পর মুখ বন্ধ হয় সমালোচকদের।
পল পগবা
২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে উড়িয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ফ্রান্স। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ছিলেন পল পগবাসহ সাতজন মুসলিম ফুটবলার। ২৩ সদস্যের স্কোয়াডের মধ্যে ১৫ জনই ছিলেন আফ্রিকান। মজার বিষয় হলো, এই বিশ্বকাপ জেতার পরও জন্মসূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি করা ফরাসি দল নিয়ে বর্ণবৈষম্য ও অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
এর জবাবটা অবশ্য ভালোমতো সে সময় দিয়েছিলেন ইসলামভীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় মার্কিন লেখক খালেদ বেইদউন। বহুজাতিক এই দলের জন্য ‘সুবিচার’ দাবি করে একটি টুইট করেছিলেন। টুইটটা ছিল এমন, ‘বিশ্বকাপ জেতায় ফ্রান্স দলকে অভিনন্দন। ফ্রান্সের ৮০ ভাগ খেলোয়াড় আফ্রিকান, বর্ণবৈষম্য ও বিদেশী ভীতি বর্জন করুন। আপনার দলের ৫০ ভাগ খেলোয়াড় মুসলিম, ইসলামভীতি ত্যাগ করুন। আফ্রিকান আর মুসলিমরা আপনাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতিয়েছে, এবার তাদের ন্যায়বিচার দিন।’ তার এই পোস্টটি ১ লাখ ৬৩ হাজার বার রিটুইট করা হয়। লাইক ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার। তবে খেলাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন করায় বেইদউন’র সমালোচনাও করেন অনেকে। অনেকে ধারণা করেন, এই টুইটের কারণে ফ্রান্সের বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ফ্রান্স দলের দুই ধর্মপ্রাণ মুসলিম খেলোয়াড় মাঠে আনন্দ প্রকাশ করেন সিজদা দিয়ে। পল পগবা ও জিবরিল সিদিবে ওই উদযাপন মুসলিম দর্শক ও ভক্তদের মনে অন্যরকম আনন্দ দিয়েছিল। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ফরাসিদের জয়ে দেশটির নাগরিকরা বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের জাতীয় জীবনের অনেক বড় অর্জন। এটি প্রমাণ করেছে, একসাথে কাজ করলে অনেক বড় কিছু অর্জন করা সম্ভব।’
পল পগবা তো সে সময় বলেই দিয়েছিলেন, ‘আজকের ফ্রান্স নানা রঙে রাঙানো। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা অবস্থান করছে। তারা সবাই মিলে ফ্রান্সকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। আমরা সবাই ফ্রান্সকে অনুভব করি, হৃদয় দিয়ে ধারণ করি। আমরা খুব খুশি এবং গর্বিত জাতীয় দলের এই টি শার্টটি পরতে পেরে।’
তবে পগবার সে উচ্ছ্বাসে এখন কিছুটা ভাটা পড়েছে। আর সেটা সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সের একটি ম্যাগাজিনে মহানবী সা:-কে নিয়ে কার্টুন প্রকাশ ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ইসলাম ধর্ম নিয়ে তীর্যক মন্তব্যের কারণে। শুধু পগবাই নয় এখন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করছে মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রগুলোও।
মুসলিম ফুটবলারদের মধ্যে ফ্রান্স দলে বর্তমানে সবচেয়ে তারকা ফুটবলার পল পগবাই। ক্লাব পর্যায়ে তিন খেলছেন ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে। তার বাবা-মা আফ্রিকার দেশ গিনি থেকে ফ্রান্সে অভিবাসন গ্রহণ করেন। ১৯৯৩ সালে জন্ম নেয়া পগবার ধার্মিক হিসেবে বেশ সুনাম রয়েছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ওমরা পালন করে রাশিয়া গিয়েছিলেন তিনি। ফাইনালে ছিল তার দৃষ্টিনন্দন একটি গোল। শুধু পগবা নয়, অনেক তারকা ফুটবলার আছেন, যারা বিশ্বকাপ জেতানোর পাশাপাশি এখনো ফ্রান্স দলকে সেরাটা দিয়ে যাচ্ছেন।
আদিল রামি, জিবরিল সিদিবে
রাশিয়া বিশ্বকাপে ফ্রান্সের দলে ছিলেন আরেক মুসলিম ফুটবলার আদিল রামি। ১৯৮৫ সালে ফ্রান্সের কর্সিকায় মরোক্কান বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম তার। অন্যদিকে জিবরিল সিদিবে অন্যতম একজন রক্ষণভাগের সেনা। সেনেগালের বংশোদ্ভুত এই খেলোয়াড়ের জন্ম ১৯৯২ সালে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে তিনি মোনাকোর পক্ষে লিগ ওয়ান শিরোপা জয় করেন। এখনো তিনি খেলে যাচ্ছেন ফ্রান্সের হয়ে, ক্লাব সেই মোনাকোই।
বেনজামিন মেনদি
বেনজামিন মেনদি ফ্রান্সের আরেক রক্ষণভাগের খেলোয়াড়। তিনিও মুসলিম। তার জন্মের আগেই তার পরিবার অভিবাসী হয়ে ফ্রান্সে আসেন। ফ্রান্সেই ১৯৯৪ সালে তার জন্ম। বর্তমানে তিনি ইংলিশ লিগে ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলছেন।
এনগোলো কান্তে
এনগোলো কান্তে। ১৯৯১ সালে প্যারিসে জন্মগ্রহণকারী ফ্রান্সের মধ্যমাঠের এই ফুটবলারের পরিবার মালি থেকে ফ্রান্সে অভিবাসন করেন। ২০১৫ সালে তিনি লেস্টার সিটির পক্ষে ক্লাবটির ইতিহাসের প্রথম প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ইংলিশ ফুটবল দল চেলসির পক্ষে খেলছেন। জাতীয় দল ফ্রান্সের হয়ে খেলছেনই।
নাবিল ফেকির
নাবিল ফেকির অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। তিনি জিদানের মতো আলজেরীয় বংশোদ্ভূত। ১৯৯৩ সালে ফ্রান্সের লিওনে জন্ম। বিশ্বকাপ জেতানো ফুটবলার। এখনো খেলে যাচ্ছেন। তার ক্লাব চেলসি।
উসমান ডেম্বেলে
বার্সেলোনায় খেলছেন উসমান ডেম্বেলে। জাতীয় দল ফ্রান্স। আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড়ের বাবা মালি থেকে ফ্রান্সে আসেন। অন্যদিকে তার মা একইসাথে মৌরিতানিয়া ও সেনেগালীয় বংশোদ্ভূত। উসমান ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সের ভেরননে জন্মগ্রহণ করেন।
কিলিয়ান এমবাপ্পে
ফ্রান্সের আক্রমণভাগে অন্যতম প্লেয়ার কিলিয়ান এমবাপ্পে। এই তারকার শরীরেও বইছে মুসলিমের রক্ত। তার বাবা উইলফ্রাইড ক্যামেরুন থেকে ফ্রান্সে চলে আসেন। বিয়ে করেন আলজেরিয়ার মেয়ে ফাইজা লামারিকে। বাবা খ্রিস্টান কিন্তু মা ফাইজা মুসলিম। বাবার ধর্মান্তরিতের কথা শোনা গেলেও, তা নিয়ে আছে ধোঁয়াশা। তবে তার মা পারিবারিকভাবেই মুসলিম।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা