০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

নারী ফুটবল দলের ‘কোচ হটাও’ বিদ্রোহের নেপথ্যে কী রয়েছে?

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাবিনা খাতুন - ছবি - ইন্টারনেট

বাংলাদেশের জাতীয় নারী ফুটবল দলের একটা অংশ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কাছে একটা শক্ত বার্তা দিয়েছে, ‘হয় কোচ নতুবা আমরা’ অর্থাৎ বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের বর্তমান কোচ পিটার বাটলারের অধীনে আর খেলতে চাচ্ছেন না দলটির সিনিয়র ফুটবলারদের একটা বড় অংশ।

বৃহস্পতিবার সাবিনা খাতুন, সানজিদা, শামসুন্নাহার, ঋতুপর্ণা, মাসুরা, মনিকার মতো তারকা ফুটবলারসহ মোট ১৮ জন সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বিবৃতি দেন।

এসময় কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাবিনা।

ফুটবলাররা জানান, ২০২৪ সালের সাফ ফুটবল আসর থেকেই কোচের সাথে দৃশ্যত একটা দূরত্ব দেখা যাচ্ছিল, পরে ‘কোচের আচরণের কারণে’ সেই দূরত্ব একটা দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে, তারা এখন এই কোচের অধীনে খেলা চালিয়ে নিতে অপারগ।

যদি কোচের বিষয়ে কোনো সুরাহা না করে ফেডারেশন। তবে এই ফুটবলাররা পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন।

কোচ পিটার বাটলার কে?
পিটার বাটলার ৫৮ বছর বয়সী একজন ফুটবল কোচ যিনি ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাথে কাজ করছেন।

এর আগে, তিনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের এলিট ফুটবল অ্যাকাডেমির কোচ হিসেবে বাংলাদেশের ফুটবলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

ব্রিটেনে প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল খেলা এই কোচ এর আগে লাইবেরিয়া ও বোতসোয়ানার জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

নানা বিতর্কিত ঘটনার পরেও বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে পিটার বাটলারের অধীনেই দক্ষিণ এশিয়ান নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছিল।

তবে তখন ফুটবলাররা কোচের ওপর নাখোশ ছিলেন তা প্রকাশ্যে এসেছে।

কোচের বিরুদ্ধে ফুটবলারদের অভিযোগ কী?
সাবিনা, সানজিদাদের এই বিদ্রোহী ফুটবলারের দল একটা তিন পৃষ্ঠার লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন সাংবাদিকদের।

বিবৃতিতে তারা বডি শেমিং থেকে শুরু করে বৈষম্য, মানুষ হিসেবে ছোট করে দেখা, গালাগালি, মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন কোচের বিরুদ্ধে।

ফুটবলাররা লিখেছেন, মাঠ ও মাঠের বাইরে কোচ তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন, ‘আমাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেন। দলের অভ্যন্তরে খেলোয়াড়দের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়রের কথা বলে বিভাজনের সৃষ্টি করেছেন। মেয়েদের পোশাক-আশাক নিয়ে কথা বলতে ছাড়েননি। বডি শেমিংও করেছেন। মেয়েদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেন, বাজে মন্তব্য করেন কোচ।’

শুধু তাই নয় পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে গালিগালাজের অভিযোগও তুলেছেন ফুটবলাররা, ‘পিটারের কাছ থেকে আমাদের অনেক গালিগালাজ শুনতে হয়েছে। আমাদের মানসিক হয়রানি এবং উৎপীড়নের একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছেন কোচ। তার কারণে ক্যাম্পে একটি আতঙ্ক বিরাজ করছে। খেলোয়াড়রাও তাতে ভীষণ অসম্মানিত এবং হতাশার মধ্যে সময় কাটাচ্ছে।’

এই পরিস্থিতির নেপথ্যে কী কী ইস্যু?
সংবাদ সম্মেলনে সাবিনার কান্নার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে এখন বেশ ভাইরাল, তবে এটার ভিন্ন ব্যাখ্যাও অনেকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের দু’টি জেলায় নারী ফুটবল ম্যাচ বাধার মুখে পড়েছিল, অনেকেই এই ম্যাচ না হওয়া এবং সাবিনাদের ‘বিদ্রোহী’ সংবাদ সম্মেলনের প্রেক্ষাপট এক করে ফেলেছেন।

সাবিনাদের পুরো ঘটনা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কেন্দ্রিক, আরো নির্দিষ্ট করে বললে কোচ কেন্দ্রিক।

এরই মধ্যে কোচের সাথে চুক্তি নবায়ন করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন।

সাবিনাদের এই বিদ্রোহের পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বেশ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেন, ‘এখনই বিস্তারিত কোনো কথা বলব না, তবে এর পেছনে কারা আছেন সেটা বের করার চেষ্টা করছি।’

দুই পক্ষের সাথেই কথা বলে সমঝোতার চেষ্টা করা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বাফুফের এই শীর্ষ অফিশিয়াল।

বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি ইমরুল হাসান বলেছেন, ‘কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে বাংলাদেশের ফুটবল জিম্মি নয়।’

বাফুফের কর্তাদের কথায়, ‘কোনো এক পক্ষের’ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

কোচের সাথে ফুটবলারদের মনোমালিন্যের সূত্রপাত হয়েছিল ২০২৪ সালের জুন থেকেই। তখনই সাবিনাসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র ফুটবলারদের বেঞ্চে বসিয়ে তুলনামূলক কম বয়সীদের খেলানোর কথা ভাবেন পিটার বাটলার।

বাংলাদেশের ফুটবল বিশ্লেষক রানা শেখের মতে, সমস্যাটা ১৭-১৮ জন ফুটবলারকে নিয়ে নয়, মূলত তিন থেকে চারজন সিনিয়র ফুটবলারকে ঘিরেই এই বিদ্রোহ।

‘সমস্যা আসলে ১৭-১৮ জনকে নিয়ে নয়। সমস্যা হচ্ছে হাতে গোনা সর্বোচ্চ তিন থেকে চারজনকে নিয়ে। যাদের বাটলার বেঞ্চে বসিয়ে নতুন খেলোয়াড়দের ট্রাই করেছে।’

তিনি বলছেন, তাদেরই কাউকে বাটলার ওজন কমাতে বলেছেন, এটাকেই তারা ‘বডি শেমিং’ বলছেন।

এরপর সাফ ২০২৪ এর মধ্যেও গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল দলের ভেতর গ্রুপিং ও কোন্দলের কথা, কোচের নানা সিদ্ধান্তেই অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন ফুটবলাররা।

তার সাথে যোগ হয়েছে মেয়েদের কাছে প্রতিশ্রুত নানা ধরনের অর্থ বকেয়া থাকা।

এমনকি সাফ জিতলে যে বোনাস দেয়ার কথা ফুটবল ফেডারেশনের সেটাও এখনো দেয়া হয়নি।

আর অক্টোবরের পর নারী ফুটবল দলের সাথে চুক্তি নবায়ন করেনি বাফুফে।

নারী ফুটবলারদের দেয়া তিন পৃষ্ঠার সেই বিবৃতির বয়ান এভাবেই শেষ হয়েছে, ‘গত অক্টোবরের পর ফুটবলারদের সাথে বাফুফে চুক্তি নবায়ন করেনি। তাই আইনত বাফুফে আমাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার রাখে না। তারপরও যদি সেরকম কিছু করার সিদ্ধান্ত হয় এবং পিটার বাটলারকেই রেখে দেয়ার সিদ্ধান্তে বাফুফে অনড় থাকে, তবে আমরা একযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হব। ভেবে নিব, দেশের নারী ফুটবলে আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।’

বাফুফে পিটার বাটলারের পক্ষে আছে এখনো পর্যন্ত, শনিবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ১৩ জন ফুটবলার নিয়ে অনুশীলন করাচ্ছেন পিটার বাটলার।

৩১ জন ফুটবলারকে ক্যাম্পে ডেকেছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)।

১৩ জন বাটলারের অধীনে প্রথম অনুশীলন করেছেন। কোচের অপসারণ চাওয়া ১৮ জন ফুটবলারের কেউই অনুশীলনে উপস্থিত ছিলেন না।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement

সকল