২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ফারাক্কার ১০৯ গেট খুলে দিলো ভারত

এবার উত্তর-মধ্যাঞ্চলে বন্যার শঙ্কা
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী (ফরিদপুর অঞ্চল) উদয়পুর ক্যাম্পর পাশে ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করছেন : নয়া দিগন্ত -


বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি জেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির মাঝে মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত। প্রবল বৃষ্টির কারণে দেশটির বিহার ও ঝাড়খন্ড রাজ্যে বন্যা ও পানির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বাঁধ খুলে দেয়া হয় বলে জানানো হয়েছে। এর ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের মুর্শিদাবাদসহ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ দিকে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্টি হওয়া বন্যা পরিস্থিতি ও ভূমিধসের বিষয়ে বাংলাদেশকে আগেই তথ্য জানিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে দাবি করেছে ভারত। ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প সূত্রের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম নিউজ১৮ বলছে, বিহার ও ঝাড়খন্ডে বিপুল বৃষ্টি হওয়ায় ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের পানির স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে পানির চাপ সামলাতে ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে এক দিনেই বাংলাদেশে ১১ লাখ কিউসেক পানি ঢুকবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পে যে পরিমাণ পানি আসছে, সেই পরিমাণ পানি ছাড়া হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ এলাকায় পানি বিপদসীমার ৭৭ দশমিক ৩৪ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধে পানির অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে। পানির চাপ বাড়ায় তা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। কর্মকর্তারা বলেছেন, পানি না ছাড়া হলে ফারাক্কা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দেশটির এই সংবাদমাধ্যম বলেছে, ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় দৈনন্দিন পানি ছাড়ার পরিমাণ বাড়ছে। এ দিকে এই পানি ছাড়ার ফলে গঙ্গা থেকে পানি ঢুকছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়। বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলায়। বিহার, ঝাড়খন্ডসহ গঙ্গার উচ্চ অববাহিকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হওয়ায় গঙ্গায় হু হু করে পানি বাড়ছে। ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেয়ায় বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলোতে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিবেশী দুই রাজ্য বিহার, ঝাড়খন্ডে বন্যা দেখা দেয়ায় ফারাক্কা বাঁধে পানির চাপ রয়েছে। তবে নেপালের পাহাড় থেকে এখনো কোনো পানি নেমে না আসায় কিছুটা স্বস্তি রয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ এলাকায় বিপদসীমা থেকে ৭৭ দশমিক ৩৪ মিটার ওপরে পানি প্রবাহিত হওয়ায় শনিবার গেট খুলতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফিডার ক্যানেলে পানির পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে ১৯৬২ সালে এই বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই বাঁধের কাজ শেষ হয় ১৯৭০ সালে। ফারাক্কা বাঁধের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল।

পদ্মায় পানি বাড়ছে
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেট খুলে দেয়ায় বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। পদ্মায় প্রতি তিন ঘণ্টায় ১ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে পানি। গতকাল সোমবার ফারাক্কার ১০৯টি গেট খোলার কথা বলা হলেও গত রোববার থেকেই পানি বাড়ছে বলে পাউবোর উত্তরাঞ্চলীয় পানিবিজ্ঞান পরিমাপ বিভাগ জানিয়েছে। এ দিকে রাজশাহীর বড়কুঠি পয়েন্টে এখন পদ্মার পানি বিপদসীমার ১ দশমিক ৭৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঁধ খুলে দেয়ায় বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে উত্তরাঞ্চলে।
পানিবিজ্ঞান পরিমাপ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাংখা এলাকা দিয়ে ভারতের গঙ্গা নদী পদ্মা নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই পয়েন্টে সোমবার ভোর ৬টা ও সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা পাওয়া গেছে ২০ দশমিক ৪৮ মিটার। বেলা ৩টায় তা হয় ২০ দশমিক ৫০ মিটার। পাংশায় পদ্মার পানির বিপদসীমা ২২ দশমিক ৫ মিটার। পাংশার ভাটিতে রাজশাহী নগরীর বড়কুটি পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানির বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। সোমবার ভোর ৬টায় এখানে পানির উচ্চতা ১৬ দশমিক ২৭ মিটার। সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা আরো এক সেন্টিমিটার বেশি পাওয়া যায়। বেলা ৩টায় পানির উচ্চতা পাওয়া যায় ১৬ দশমিক ৩০ মিটার।
বড়কুঠির আরো ভাটিতে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সারদায় পদ্মার পানির বিপদসীমা ১৬ দশমিক ৯২ মিটার। সোমবার সকাল ৬টায় এখানে পানির উচ্চতা ১৫ দশমিক ৫ মিটার এবং সকাল ৯টা ও বেলা ৩টায় পানির উচ্চতা পাওয়া গেছে ১৫ দশমিক ৬ মিটার। এখন রাজশাহীর বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ১ দশমিক ৭৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলীয় পানিবিজ্ঞান পরিমাপ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সাধারণত ১০ দিনের জন্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে পদ্মাসহ অন্যান্য নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে না। তবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না পানি বাড়ার কারণে। রোববার দুপুর থেকেই পানি বাড়ছে। আরো দু-তিন দিন পার হলে বোঝা যাবে প্রকৃত অবস্থা।

কুষ্টিয়ায় আতঙ্ক, বিওপি ক্যাম্প ঝুঁকিতে
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, একসাথে ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেট খুলে দেয়ায় কুষ্টিয়া অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে গতকাল বিকেল পর্যন্ত কুষ্টিয়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা ও গড়াই নদীর পানি বিপদসীমার সোয়া ২ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। প্রশাসন এ বিষয়ে নজর রাখছে। সীমান্তবর্তী দৌলতপুর উপজেলার উদয়নগর বিজিবির বিওপি ক্যাম্প মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, নদীকূলবর্তী কুষ্টিয়া অঞ্চলের ২/১টি পয়েন্ট ছাড়া সবগুলোর অবস্থা ভালো রয়েছে। এর মধ্যে দৌলতপুরে বিজিবির উদয়নগর বিওপি ক্যাম্প মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই ক্যাম্পটি পদ্মা নদীর তিন পাশ দিয়ে ঘেরা। এই ক্যাম্পর ৫০ গজের বাইরে পানির অবস্থান। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী (ফরিদপুর অঞ্চল) ওই স্থানটি পরিদর্শন করেছেন। এ ছাড়া ভেড়ামারা উপজেলার মসলেমপুর এলাকার বাঁধের ভাঙনরোধে কয়েক দিন ধরে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে।
এ দিকে কুষ্টিয়া শহর রক্ষা মঙ্গলবাড়ির বাঁধে গত সপ্তাহে পর্যাপ্ত বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে বুঝা যাবে ফারাক্কার পানির বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিজিবি ৪৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহবুব মুর্শেদ জানান, উদয়নগর বিওপি ক্যাম্প ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ক্যাম্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পার্থ প্রতিম শীল জানান, ফারাক্কার পানি বৃদ্ধিতে কুষ্টিয়ার উপর কী প্রভাব পড়বে তা এ অবস্থায় বলা মুশকিল। তবে নদী রক্ষা বাঁধগুলো ভালো রয়েছে। তিনি জানান, মঙ্গলবার দুর্যোগ প্রতিরোধ কমিটির সভায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরো জানান, ভেড়ামারার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১৪.২৫ সেন্টিমিটার। সোমবার দুপুরে সেখানে ১২ সেন্টিমিটার পানি রেকর্ড করা হয়েছে। তবে ফারাক্কার পানি আসায় পানির পরিমান বৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এ দিকে সোমবার বিকেলে ফারাক্কার গেট খুলে দেয়ার খবরে পুরো জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement