হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থন নিয়ে দোটানায় যুক্তরাষ্ট্র
ইসরাইলি হামলায় নিখোঁজ ২১ হাজার ফিলিস্তিনি শিশু- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২৫ জুন ২০২৪, ০০:০৫
যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ প্রধান ও মার্কিন বিমানবাহিনীর জেনারেল চার্লস কিউ ব্রাউন বলেছেন, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে ইসরাইলকে সেভাবে রক্ষা করতে পারবে না, যেভাবে চলতি বছরের এপ্রিলে ইরানের ড্রোন হামলার সময় করেছিল। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সমর্থন করলে ইরান হিজবুল্লাকে সমর্থন দিতে আরো বেশি ঝুঁকবে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও যুদ্ধ চলবে। এ দিকে ইসরাইলি হামলার শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২১ হাজার শিশু নিখোঁজ রয়েছে। তারা এই শিশুদের খুঁজতে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়েছে। সিএনএন, আলজাজিরা ও রয়টার্স।
কিউ ব্রাউন বলেন, ইরান ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকেও সমর্থন করে। কিন্তু লেবাননে যুদ্ধে জড়ালে তেহরান আরো দৃঢ়ভাবে হিজবুল্লাহর পিছনে দাঁড়াবে। বিশেষ করে, যদি তারা মনে করে যে হিজবুল্লাহকে উল্লেখযোগ্যভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। আর লেবাননে ইসরাইলের যে কোনো সামরিক আক্রমণ একটি বিস্তৃত যুদ্ধের সূচনা করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিপদে ফেলতে পারে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) হিজবুল্লাহ ক্রমাগত আক্রমণ বন্ধ করতে লেবাননে সংগঠনটির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করার পর ব্রাউনের এসব মন্তব্য সামনে এলো।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রোববার রাতে চ্যানেল ১৪ কে বলেন, ইসরাইল হিজবুল্লাহ হুমকির বিপরীতে একটি কূটনৈতিক সমাধানের জন্য উন্মুক্ত। তবে এটি অবশ্যই আমাদের শর্তে হতে হবে। আমরা যা প্রয়োজন তা করবো। ‘আমি ইসরাইলের নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে পারি যে যদি আমাদের হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই তা করবো। আমরা বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করতে পারি ও তার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছি।’
ব্রাউন বলেন, এই বছরের শুরুতে ইরান যখন ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র নেতানিয়াহুকে যে ধরনের সহায়তা দিয়েছিল, হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে, তেমন সহায়তা দিতে পারবে না। আর সীমান্ত পেরিয়ে হিজবুল্লাহ ইসরাইলে যে স্বল্প পাল্লার রকেট নিক্ষেপ করে, সেগুলো প্রতিহত করা বেশ কঠিন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মূল অগ্রাধিকার ছিল মার্কিন বাহিনীর সুরক্ষা। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এই অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিতে কোনো আক্রমণ করা হয়নি। তাই লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়ে ইসরাইলকে সতর্ক করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। লেবাননে যে কোনো ধরনের সামরিক অভিযানের প্রভাব সম্পর্কে ইসরাইলকে চিন্তা করার আহ্বান জানান কিউ ব্রাউন। তাদের এই আক্রমণ যে শুধু ওই অঞ্চলকেই প্রভাবিত করবে তা নয়, ওই অঞ্চলে থাকা মার্কিন সেনাদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ইসরাইলকে অবশ্যই এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
এর আগে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরাইলের সর্বাত্মক যুদ্ধ বাধলে ইহুদি রাষ্ট্রটিকে সমর্থন দেবে বলে জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। চলতি সপ্তাহে ওয়াশিংটনে সফরকারী ইসরাইলি কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদলকে এমনই আশ্বাস দিয়েছিলেন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা সিএনএনকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
ইসরাইলি হামলায় ফিলিস্তিনের ২১ হাজার শিশু নিখোঁজ : গাজায় গত বছরের ৭ অক্টোবর হামলা শুরু করে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। এতে দুই পক্ষের যোদ্ধাদের পাশাপাশি মারা গেছে হাজারো বেসামরিক ফিলিস্তিনি। একের পর এক আবাসিক এলাকায় চলেছে ইসরাইলি সেনাদের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নারী-পুরুষের পাশাপাশি রেহাই মেলেনি শিশুদেরও। অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটেনভিত্তিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলার শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২১ হাজার শিশু নিখোঁজ রয়েছে। তারা এই শিশুদের খুঁজতে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়েছে। অন্য দিকে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, অপুষ্টিতে গাজায় আরো দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কামাল আদওয়ান হাসপাতালে তারা মারা গেছে তারা। এ নিয়ে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মোট মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল ৩১-এ। কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরার ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের লাইভ আপডেটে এসব তথ্য জানিয়েছে।
শিশু অধিকার সংস্থা ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইনের মহাপরিচালক খালেদ কুজমার বলেছেন, ‘গাজায় শিশুদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন সহিংসতা দেখানো হয়েছে। এটা শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’ তিনি বলেন, গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার সবচেয়ে চরম মূল্য দিতে হয়েছে গাজার শিশুদের। তিনি আরো বলেন, ‘শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। গাজায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী নিয়মতান্ত্রিকভাবে শিশুদের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে এবং করেই যাচ্ছে।’
চুক্তি হলেও যুদ্ধ চলবে : অন্য দিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও যুদ্ধ চলবে। এমনকি তিনি এমন কোনো চুক্তিতে সম্মত না হওয়ার কথাও জানিয়েছেন, যা গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের অবসান ঘটায়। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি একটি ‘আংশিক’ চুক্তির বিষয়ে সম্মত হতে রাজি যা গাজায় এখনো আটক থাকা কিছু বন্দীকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে, এমনকি সবাইকে না হলেও।
তবে তিনি পুনর্ব্যক্ত করেছেন, তিনি এমন কোনো চুক্তিতে সম্মত হবেন না যা গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের অবসান ঘটায়। যদিও ইসরাইলি প্রস্তাব এই আক্রমণাত্মক অভিযান শেষ করার পথে এগিয়ে যাবে বলে আগেই দাবি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। রোববার ইসরাইলি মিডিয়া আউটলেট চ্যানেল ১৪-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘লক্ষ্য হচ্ছে অপহৃতদের ফিরিয়ে আনা এবং গাজায় হামাস সরকারকে উৎখাত করা।’
অবশ্য কয়েক হাজার ইসরাইলি নেতানিয়াহু এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সমাবেশ করে চলেছে। তারা ইসরাইলে আগাম নির্বাচনের দাবির পাশাপাশি বন্দীদের ফিরিয়ে আনতে চুক্তির দাবি জানাচ্ছেন। নেতানিয়াহু চ্যানেল ১৪-কে আরো বলেন, দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে ইসরাইলের ‘তীব্র’ সামরিক আক্রমণ প্রায় শেষ হয়েছে। তার ভাষায়, ‘হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তীব্র পর্যায় শেষ হতে চলেছে। এর মানে এই নয় যে, যুদ্ধ শেষ হতে চলেছে, তবে রাফাতে যুদ্ধের তীব্র পর্যায় শেষ হতে চলেছে।’ অন্য দিকে, হামাস বলছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৩১ মে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, নেতানিয়াহু তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ত্রাণ কেন্দ্রে বিমান হামলা : ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত একটি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কলেজে ইসরাইলের বিমান হামলায় আট ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তারা জানান, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কলেজটি জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালনা করত, সেটি এখন উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, রোববার বিমান থেকে ছোড়া বোমা এর একটি অংশে আঘাত হেনেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন মোহাম্মদ তাফেশ বলেছেন, ‘কিছু মানুষ কুপন নিতে এখানে আসছিলেন আর অন্যরা বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। কয়েকজন পানি ভরছিলেন আর অন্যরা কুপন নিচ্ছিল আর এ সময় হঠাৎ করে আমরা কিছু পড়ার শব্দ শুনলাম। আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি যারা পানি ভরছিল তারা পড়ে আছে।’ রয়টার্সের একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক দেখেছেন, একটি নিচু ভবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে আছে আর রাস্তার পাশে কম্বল দিয়ে মুড়ে লাশগুলো রাখা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
আট মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা গাজা যুদ্ধে ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পারিণত হয়েছে এবং এ পর্যন্ত ৩৭,৬২৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৮৬,০৯৮ জন আহত হয়েছেন বলে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
গাজায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিহত : ইসরাইলি হামলায় ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের এক ঊর্ধ্বতন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। নিহত ওই কর্মকর্তার নাম হানি আল-জাফরাভি। তিনি গাজা উপত্যকার অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি বিভাগের পরিচালক ছিলেন। ভূখণ্ডটির একটি ক্লিনিকে গোলাবর্ষণ করে ইসরাইলি বাহিনী তাকে হত্যা করে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা শহরের দারাজ ক্লিনিকে ইসরাইলের গোলাবর্ষণে উপত্যকাটির অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি বিভাগের পরিচালক হানি আল-জাফরাভি নিহত হয়েছেন।
ভূখণ্ডটির মন্ত্রণালয় আরো বলেছে, গাজার স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে ইসরাইলি বাহিনী পদ্ধতিগতভাবে লক্ষ্যবস্তু করা সত্ত্বেও তারা চিকিৎসা সম্পর্কিত মানবিক দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একই সঙ্গে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য আবারো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মন্ত্রণালয়টি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা