১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কালো টাকায় ঢালাও দায়মুক্তি

-

- ১৫% কর দিয়ে ব্যক্তির সাথে কোম্পানিও কালো টাকা সাদা করতে পারবে
- সরকারের কোনো সংস্থাই টাকা সাদাকারীদের প্রশ্ন করতে পারবে না
- ব্যাপক করারোপে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় আরো বাড়বে

আপনি যদি একজন সৎ করদাতা হোন তবে আপনার ওপর সর্বোচ্চ কর ধার্য আছে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ, আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ আয়কর সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হবে। কিন্তু কেউ যদি কালো টাকার মালিক হোন তবে তিনি ৩০ শতাংশ নয়, মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তার যত খুশি কালো টাকা সাদা করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, তিনি এই টাকা কোথা থেকে ‘উপার্জন’ করেছেন আয়কর অফিসের কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন করবেন না। এখানেই শেষ নয়, ভবিষ্যতে সরকারের কোনো সংস্থা এ অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা তো দূরের কথা, ‘টুঁ’ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারবে না। এভাবে ‘ইনডেমনিটি’ বা দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে কালো টাকার মালিকদের। নজিরবিহীনভাবে ব্যক্তির পাশাপাশি কোম্পানিও এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন। কালো টাকার মালিক ব্যক্তি ও কোম্পানিকে অর্ধেক কর দিয়ে অর্থ সাদা করার এই ঢালাও সুযোগটি করে দেয়া হয়েছে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে।
কেন এই সুযোগটি দেয়া হচ্ছে তার পেছনে ‘যুক্তি’ও দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, রিটার্ন দাখিলে করদাতার অজ্ঞতাসহ অনিবার্য কিছু কারণে অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এই অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নে এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দেয়া এবং অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আয়কর আইনে কর প্রণোদনা সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করতে পারেন। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫% কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।
স্রেফ রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য এই কাজটি করা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি এবং তা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য একদিকে অধিক পরিমাণ রাজস্ব জোগান দিতে হবে এবং অন্য দিকে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে হবে। ডাটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালু হওয়ার ফলে বিভিন্ন কোম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও পরিসম্পদ প্রদর্শনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে এই বাজেটটি আলোচনার জন্য উত্থাপন করেছেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি সংসদ সদস্যরা এ সময় নীরবে অর্থমন্ত্রীর এই বাজেট বক্তব্য শুনেছেন। সাত লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার এই বাজেটটি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে মাহমুদ আলী প্রথম বাজেট।
ঘরে বাইরে খরচ বাড়বে সাধারণ মানুষের : বিনা প্রশ্নে অবাধে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে ৮২ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রী ‘বিসমিল্লাহ’তে বেশ চমকই দেখালেন। এতে কালো টাকার মালিকরা পুলকিত বোধ করলেও সাধারণ নাগরিক ও সৎ করদাতাদের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট তেমন কোনো সুখবর বয়ে আনেনি। টানা বছরখানিক ধরে ৯ শতাংশের উপরে থাকা জীবন যাত্রার ব্যয় নির্ধারণী মূল্যস্ফীতির হার যখন ঊর্ধ্বমুখী এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যে লাগামহীন ব্যয়ে যখন দেশের সাধারণ মানুষদের মাটিতে শুয়ে পড়ার উপক্রম- তখন অর্থমন্ত্রী ২১০ পাতার বাজেট বক্তৃতা তাদের খুব কমই স্বস্তি দেবে। এখন কেউ যদি বাসায় ফ্রিজ বা এসি কিনতে চান তবে তাকে আগামীতে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। কারণ এই দুটি পণ্যের ওপর করভার বাড়ানো হয়েছে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে যদি কেউ বিনোদন পার্কে বেড়াতে যান সেখানেও বেশি টাকা ব্যয় করতে হবে। কারণ বাজেটে বিনোদন বা অ্যামুজমেন্ট পার্কের ওপর বাড়তি কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দেশে উৎপাদন হওয়ায় পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। ফলে বিশুদ্ধ পানি খেতেও দিতে হবে বেশি পয়সা। বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ে অনেকে বাসায় এলইডি বাল্ব ব্যবহার করেন। এলইডি বাল্ব এবং এনার্জি সেভিং বাল্ব উৎপাদনের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
পুরো এডিপিই বাস্তবায়িত হবে কর্জ করে! : আগামী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অন্য দিকে, ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতিই হবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি আবার মেটানো হবে ব্যাংক ঋণ ও বিদেশী ঋণ নিয়ে। ফলে এডিপি প্রায় পুরোটায় ঋণের টাকায় বাস্তবায়ন করা হবে।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ৯ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ’ করা হবে। কিন্তু এই ‘শৃঙ্খলা’ কিভাবে নিশ্চিত করা হবে সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি। আর্থিক খাত যে অনেক দিন ধরে বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে তার প্রমাণ দেখা যায় অনেকটা হু হু করে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। যা কি না এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। অনেক দিন ধরে দেশের অর্থনীতিবিদরা ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা আনতে একটি ব্যাংকিং কমিশন করার কথা বলে আসছেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তার পূর্বসূরিদের মতো এ বিষয়ে বাজেটে কিছু বলেননি।
রিজার্ভ কত : অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ( ১১ পৃষ্ঠায়) বলেছেন, ‘চলতি বছরের মে মাসের শেষে দেশের গ্রস রিজার্ভ ২৪.২২ বিলিয়ন ডলার।’ কিন্তু এ হিসাব নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ বর্তমানে গ্রস রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আর নিট তো ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে নেমে গেছে। তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো ডলার রিজার্ভে নেই।
রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য আগামীতে কর অব্যাহতি ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে নেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থনীতি। এতে করের বোঝা বাড়বে সাধারণের ওপর।
মূল্যস্ফীতি : অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে তাকে ‘সরবরাহ বিচ্যুতি’জনিত সমস্যা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করা হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ তিনি দেননি। তবে তিনি বলেছেন, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থাকবে। কিন্তু এটিও বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক ঋণই ভরসা : আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার বড় এক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি শুধু ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাত তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। এ সময়ে সরকার বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ নেয়া হলে অনিবার্যভাবে দেশের বেসরকারি খাত ঋণ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকিং খাত এখন দুর্বল। এমন অবস্থায় সরকার যদি ব্যাংক থেকে ঘাটতি মেটানোর জন্য এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার করে, তাহলে ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করবে। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হবে না।
আয়ের উচ্চাভিলাষী টার্গেট : আগামী অর্থবছরে আয়ের একটি উচ্চাভিলাষী টার্গেট দেয়া হয়েছে। মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর থেকে আয় ধরা হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। যা কি না চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেট থেকে ৭০ হাজার কোটি এবং মূল বাজেটের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বছর শেষে এটি অর্জন করা কখনো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।


আরো সংবাদ



premium cement
চট্টগ্রামে সাবেক এমপি মোতালেবসহ ২৪৮ জনের নামে মামলা চিন্ময়ের জামিন শুনানি জানুয়ারিতেই ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ, শুরু ১০ এপ্রিল ডেঙ্গুতে আরো ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৩৪৪ ধবলধোলাই এড়াতে ৩ পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ নববর্ষের প্রকাশনা ইসলামী শ্রমনীতির প্রচারে ভূমিকা রাখবে : শামসুল ইসলাম ‘শেখ হাসিনা দেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করতে চায়’ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন করা হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা ই-সিগারেটকে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত মহেশপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু নিহত সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলা অব্যাহত

সকল