১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হতাশা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকই রাখতে চায় বিএনপি

-

৭ জানুয়ারির নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরে ‘হতাশা’ থাকলেও বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এ দেশটির সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কই বজায় রাখতে চায় বিএনপি। দলটির নীতি-কৌশলের সাথে জড়িতরা বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নানামুখী তৎপরতা চালিয়েছে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপটে হয়তো তারা চূড়ান্তভাবে সফল হতে পারেনি। তবে নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যুতে তাদের অবস্থান বদলায়নি। আগামী দিনেও তারা তাদের ভূমিকা রেখে যাবে। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা একটি দল তথা জনগণের জন্য তাদের এই ভূমিকা অতীতেও সহায়ক ছিল এবং আগামীতেও সহায়ক হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র সফরকেও বিএনপি অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখছে না। দলটি মনে করছে, কোনো দেশের সরকারের সাথে সম্পর্কের মাত্রা কেমন হবে, সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নিজস্ব কূটনৈতিক পলিসিগত বিষয়। তবে তারা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে নানামুখী তৎপরতার মধ্য দিয়ে যে আশার বীজ বপন করেছে, তা থেকে তারা পিছপা হবে না এমনটাই আশা তাদের।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ হলেও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও বটে। বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে দেশটির অবস্থান আবারো ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে। কাজেই অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু’র এবারের সফর নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই।’

তিনি বলেন, ‘ডোনাল্ড লু তার আলোচনায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র উত্তরণের যে সংগ্রাম, সে গণতন্ত্রের নীতিতে তারা অবিচল। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের জনমনে কিছুটা হলেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। তা অস্বীকার না করেও এটা বলা বোধ হয় অতিশয়োক্তি হবে না যে, ডোনাল্ড লু’র এ সফর বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর এ দেশের কোটি কোটি মানুষের আস্থা কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনবে।’
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তথা প্যালেস্টাইন, গাজা, মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন, ইরান, চীনসহ সার্বিক বিশ্বপরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেই তাদের আগামী বাংলাদেশ নীতি প্রণীত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৌড়ঝাঁপে বিএনপিতে একধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। দলটি মনে করেছিল, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা, নির্বাচন নিয়ে ভিসা নীতি প্রয়োগ, শর্ত ছাড়া সংলাপের আহ্বানসহ অবাধ, শ্রম আইনের ডিক্রি জারি, সুষ্ঠু ও নিরপক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়বে। বিএনপির নেতাকর্মীদের কথায়ও এমন মনোভাবের বিষয়টি তখন ফুটে উঠেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন হতে দেখা যায়নি। নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র সফরে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারকে নানা পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকটা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার গঠিত হয়। বিএনপির প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের হতাশ হতেও দেখা যায়।

সেই ভোটের প্রায় চার মাস পর ফের ঢাকায় সফর করেছেন ডোনাল্ড লু। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে লু’র সফর নিয়ে বিএনপির যে উচ্ছ্বাস ছিল, এবার তার বিন্দুমাত্র দেখা যায়নি। বরং এ সফরের বিষয়টি দলটির দায়িত্বশীল নেতারা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কৌশল নিয়েছেন। ফলে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা থাকলেও মার্কিনিদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার কাজটি করে যেতে চায় বিএনপি।
লু’র সফর প্রসঙ্গে বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির একাধিক নেতারও ভাষ্য হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে সংলাপ ইস্যুতে ডোনাল্ড লু’র ভূমিকায় হতাশ বিএনপি। দলটির দায়িত্বশীল নেতারাও মনে করেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ সময়ে ধীরে চলেছে। নির্বাচনের আগে কোনো পদক্ষেপ বা স্যাংশন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসেনি। নির্বাচনের পর যথারীতি সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র শক্ত কোনো অবস্থান নেয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ভবিষ্যতে কী রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে, তা নিয়ে জনমণে কৌতূহল রয়েছে। নেতাকর্মীরাও দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন। এ দিকে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য সমমনা ও শরিক দলসহ ভোট বর্জনের সাথে সম্পৃক্ত দলগুলোর সাথে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক শুরু করেছে দলটি। শিগগিরই আন্দোলনের নতুন কর্মপন্থা ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছে বিএনপি।

লু’র সাম্প্রতিক সফর নিয়ে বিএনপির মূল্যায়ন হচ্ছে, এবার তার যে কর্মসূচি, সেটি হয়তো বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করেই নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপরও ডোনাল্ড লু তার আলোচনায় এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র উত্তরণের যে সংগ্রাম, তাতে গণতন্ত্রের নীতিতে তারা অবিচল।
গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ডোনাল্ড লু’র সফর নিয়ে বলেন, ‘তার (লু’র) আগমন নিয়ে আমরা কেউ ইন্টারেস্টেড নই। আমাদের ভরসা জনগণের ওপর, সেই আস্থার ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। বাংলাদেশের জনগণ কারো ওপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনবে- এটা আমরা মনে করি না।’ এর আগের দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমাদের কাছে লু অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।’

দলটির সিনিয়র নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে কিংবা পরে মার্কিনিদের ভূমিকা যেটিই হোক না কেন, তাদের সাথে সম্পর্ক আগের মতো স্বাভাবিক গতিতেই এগিয়ে নেবে বিএনপি। পিটার হাসের পরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ডেভিড মিল বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, তার সাথেও গভীর যোগাযোগ স্থাপন করা হবে। নতুন ওই রাষ্ট্রদূতের সাথে আগে থেকেই বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের সুসম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement