ইসরাইলের সাথে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি বাতিলের হুমকি মিসরের
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১২ মে ২০২৪, ০০:০৫
- ইসরাইল-হামাসকে আলোচনায় সক্রিয় রাখার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র
- এবার ফিলিস্তিনিদের মধ্য রাফাহ ছাড়ার নির্দেশ
- গাজায় প্রাণহানি ৩৫ হাজার
- জাতিসঙ্ঘের সনদ ছিঁড়লেন ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত
মিসরীয় কর্মকর্তারা রাফায় অভিযান বন্ধ এবং যুদ্ধবিরতি আলোচনা পুনরায় শুরু করতে ইসরাইলকে চাপ দেয়ার জন্য মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) পরিচালক উইলিয়াম বার্নসকে আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যথায় মিসর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়েছে। ইসরাইলি সংবাদপত্র মারিভের বরাত দিয়ে আরব সংবাদমাধ্যম আল মায়াদিন এ খবর জানিয়েছে। রাফায় ইসরাইলের চলমান সামরিক অভিযান নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে এই হুমকি দিলো মিসর। খবর : আল মায়াদিন, রয়টার্স, আলজাজিরা, বিবিসি ও আনাদোলু।
মাত্র কয়েকদিন আগেই মিসর দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় অবস্থিত রাফাহতে ইসরাইলি সামরিক অভিযানের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মারিভ তার প্রতিবেদনে আরো বলেছেন, মিসরীয় গণমাধ্যম ক্রমবর্ধমানভাবে মিসর এবং ইসরাইলের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাতিলের আহ্বান জানিয়ে আসছে, যা ইসরাইলি কর্মকর্তাদের তাদের মিসরীয় প্রতিপক্ষকে এই আহ্বানের প্রকৃতি এবং মাত্রা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে আগ্রহী করে তুলেছিল। প্রায় ৫০ বছর আগে সই হওয়া ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তির মাধ্যমেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় কায়রো। মিসরের দু’জন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং পশ্চিমা একজন শীর্ষ কূটনীতিক ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্থগিতের হুমকির কথা নিশ্চিত করেছেন। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তাদের সূত্র উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, কায়রোর ভাষ্য হলো ইসরাইল তার সামরিক অভিযানের কেন্দ্র রাফায় আনলে সেটি গাজাবাসীর জন্য সরবরাহকৃত যাবতীয় সহায়তার পথ বন্ধ করবে।
মিসর এর আগে বহুবার শঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, গাজাবাসীর ওপর নির্বিচারে আক্রমণ মিসরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের স্রোত বাড়াবে। রাফায় ইসরাইলি অভিযান সেই শঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। রাফায় অভিযান সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে কাতার, সৌদি আরবসহ অনেক দেশই ব্যাপক হুঁশিয়ারির কথা উল্লেখ করেছে।
১৯৭৮ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও মিসরের মধ্যে ‘ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ডস’ সই করে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের অবকাশ কেন্দ্র ক্যাম্প ডেভিডে সই হওয়া এ সমঝোতায় সই করেন মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এবং ইসরাইলের পক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন। চুক্তি হওয়ার আগে দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি যুদ্ধ হয়।
আলোচনা সক্রিয় রাখার চেষ্টা : গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় ইসরাইল ও হামাস যাতে সক্রিয় থাকে সেই চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি ভার্চুয়ালি হলেও আলোচনা যাতে অব্যাহত থাকে সে জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দেশটি। শুক্রবার হোয়াইট হাউজ এ কথা জানিয়েছে। গত শুক্রবার হামাস বলেছে, ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধের আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর নিজেদের কৌশল নিয়ে অপর ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে তারা কথা বলবে।
বৃহস্পতিবার কায়রোতে কোনো সমঝোতা ছাড়াই গাজায় যুদ্ধবিরতি ও ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তির আলোচনা শেষ হয়েছে। মিসর ও কাতারের প্রস্তাবে হামাস সম্মতি জানালেও ইসরাইল বলেছে তা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এই আলোচনায় ভূমিকা রাখছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ প্রধান উইলিয়াম বার্নস। সমঝোতা ছাড়া আলোচনা শেষ হওয়াকে গভীর অনুতাপের বলে উল্লেখ করেছে হোয়াইট হাউজ। তবে ভিন্নতার অবসান সম্ভব বলে তারা মনে করে। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, এমনকি ভার্চুয়ালি হলেও দুই পক্ষকে আলোচনায় সক্রিয় রাখতে আমরা কঠোর পরিশ্রম করছি। যদিও গতকাল শনিবার পর্যন্ত শহরটির অর্ধেকের বেশি ঘিরে ফেলেছে ইসরাইলি সেনারা। হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে সেখানে তুমুল লড়াই চলছে। হোয়াইট হাউজ বলেছে, উদ্বেগের সাথে নিবিড়ভাবে ইসরাইলি অভিযান পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। রাফাহ ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভবত বড় কোনো অভিযানের ইঙ্গিত নয়।
মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল : চলমান গাজা যুদ্ধে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ইসরাইল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে থাকতে পারে। এমন ধারণার কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলছে, এটি মূল্যায়ন করা যুক্তিসঙ্গত যে, যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ করা অস্ত্র ব্যবহারে কিছু বাধ্যবাধকতা থাকলেও ইসরাইল সেসব ‘অসঙ্গতিপূর্ণ’ উপায়ে ব্যবহার করে থাকতে পারে। তবে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হাতে এই সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য নেই বলে জানিয়েছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট। এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন শুক্রবার কংগ্রেসে জমা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
গাজায় নিরীহ মানুষের প্রাণহানি বাড়তে থাকায় ধীরে ধীরে কঠোর অবস্থানে যেতে শুরু করেছে বাইডেন প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় ইসরাইলসহ অন্য পক্ষগুলো কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্র ব্যবহার করছে, তা মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েছিল হোয়াইট হাউজ। তবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে গাজায় কিছু অভিযান নিয়ে ইসরাইলের তিরস্কার করা হলেও দেশটির প্রতিরক্ষাবাহিনী সেখানে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি। গাজায় ইসরাইলকে যে ‘অভাবনীয় সামরিক চ্যালেঞ্জ’ মোকাবেলা করতে হয়েছে, সেটি বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্র ব্যবহারে আইন মেনে চলতে ইসরাইলের দেয়া নিশ্চয়তা ‘বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য’ উল্লেখ করে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখা যেতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে আরো বলা হয়েছে, গাজা যুদ্ধে হামাস সামরিক উদ্দেশে বেসামরিক স্থাপনা ও নাগরিকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে এমন একটি সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ইসরাইল সম্ভবত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে সেসব অস্ত্র ব্যবহার করেছে, অথবা বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।
এতে বলা হয়েছে, যেকোনো সামরিক অভিযানে বেসামরিক মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ইসরাইলের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং সরঞ্জাম রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের যে চিত্র, যেখানে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির মাত্রা ব্যাপক, তখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সেসব কার্যকরভাবে ব্যবহার করছে কি না। জাতিসঙ্ঘ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো গাজায় বেসামরিক ক্ষতি কমাতে ইসরাইলের প্রচেষ্টাকে ‘অসঙ্গত, অকার্যকর এবং অপর্যাপ্ত’ উল্লেখ করেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
সঙ্ঘাতের শুরুর দিকে গাজায় সর্বোচ্চ মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় ইসরাইল পুরোপুরি সহযোগিতা না করলেও সেই পরিস্থিতি এখন বদলেছে বলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মূল্যায়নে উঠে এসেছে। ‘ইসরাইলি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দিচ্ছে কিংবা সীমিত করে দিচ্ছে, আমরা সেটি এখন মনে করছি না,’ বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা দেয়া তুরস্কে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ডেভিড স্যাটারফিল্ড বলেছেন, এ ধরনের প্রতিবেদন এটাই প্রথম এবং ইসরাইলের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করার কাজটি চালিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র।
মধ্য রাফাহ ছাড়ার নির্দেশ : ফিলিস্তিনিদের এবার মধ্য রাফাহ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। ব্যাপক আকারে সামরিক অভিযানের লক্ষ্যেই গতকাল শনিবার এই নির্দেশ দিয়েছে তারা। এই হুমকিতে হাজার হাজার মানুষ বিপদে পড়েছেন। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, মিসরের রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং দখল করে নিয়েছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষাবাহিনী (আইডিএফ)। গত সপ্তাহে পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার নির্দেশের পর এটি পরিকল্পিত অভিযান ছিল।
ওই অঞ্চলের ত্রাণ সহায়তা কর্মী বলছেন, ইতোমধ্যে প্রায় দেড় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি এই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলে আইডিএফের তৈরি ‘সম্প্রসারিত মানবিক অঞ্চলে’ গিয়েছেন তারা। এ জায়গার অবস্থা আরো ভয়াবহ। মধ্য রাফাহ অঞ্চলে অভিযান চালানোর লক্ষ্যে বাসিন্দাদের নতুন করে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটি ধ্বংস ও অনেকের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
গাজায় প্রাণহানি ৩৫ হাজার ছুঁই ছুঁই : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলি বর্বর হামলায় আরো ৩৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা ৩৫ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এ ছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন আরো ৭৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। গতকাল শনিবার বার্তা সংস্থা আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বেড়ে ৩৪ হাজার ৯৭১ জনে পৌঁছেছে বলে গতকাল ভূখণ্ডটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘ইসরাইলি দখলদার (বাহিনী) গাজা উপত্যকায় পরিবারগুলোর ওপর ছয়টি গণহত্যা চালিয়েছে। এতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৯ জন শহীদ এবং আরো ৫৮ জন আহত হয়েছেন।’ মন্ত্রণালয় আরো জানিয়েছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা নির্মম ইসরাইলি হামলায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৭৮ হাজার ৬৪১ জন আহত হয়েছেন। অনেক মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছে এবং উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না।
সনদ ছিঁড়লেন ইসরাইলি দূত : জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্য পদের সমর্থনে একটি প্রস্তাব পাস করার ঠিক আগে জাতিসঙ্ঘের সনদটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিলেন ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান। সাধারণ সভায় ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দেয় ১৪৩টি দেশ। যার মধ্যে ছিল ইসরাইলের ‘বন্ধু’ ভারতও। অন্য দিকে ২৫টি দেশ এই ভোট দান থেকে বিরত থাকে। আমেরিকা ও ইসরাইলসহ ৯টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়।
কিন্তু অধিকাংশ ভোট নিয়ে প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। যার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান বলেন, আজকের এই দিনটা অন্যতম কালো দিন হিসেবে লেখা থাকবে। ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত এরদান এই প্রস্তাবটিকে জাতিসঙ্ঘ সনদের একটি ‘স্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে, এটি গত মাসে নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন ভেটোকে নস্যাৎ করেছে। ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাটজও রেজ্যুলেশন পাসের নিন্দা করেছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা