বিদ্যুতের ভর্তুকি ও ক্যাপাসিটি চার্জে আইএমএফের উদ্বেগ
এক বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ- আশরাফুল ইসলাম
- ০৩ মে ২০২৪, ০১:৩৫
গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এক বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনি পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের ভর্তুকি ও বসে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ। সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার সাথে গতকাল পৃথক পৃথক বৈঠকে এ উদ্বেগ জানিয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত এমন এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সকাল ১০টার পরে প্রথমে বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এ সময় আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওয়। আর বিদ্যুৎ বিভাগের নেতৃত্বে ছিলেন সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ প্রতিনিধিদল বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে। এ সময় তারা বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েও জানতে চায়। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে এই দুটি বিষয় নিয়ে জানানোর পর আইএমএফ প্রতিনিধিরা উদ্বেগ জানায়। পরে জ্বালানি বিভাগের সাথে পৃথক বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। তবে বৈঠকে জ্বালানি সচিব উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠকে অংশ নেয়া এক কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে আগেই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে মূল্য সমন্বয় করায় সরকারের প্রশংসা করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল।
এ দিকে, বিকেলে পেট্রোবাংলার সাথে বৈঠকে সম্প্রতি জ্বালানি বিশেষ করে এলএনজি আমদানি এবং দেশের ভেতর কাজ করা আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির বকেয়া পরিশোধ করতে না পারার কারণ জানতে চায় আইএমএফ। পেট্রোবাংলা থেকে ডলার সঙ্কটের কথা জানানো হয়। বৈঠকে পেট্রোবাংলা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান।
বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ আসলে কত : বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদন অনুসারে বিদায়ী গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৮৭ হাজার ২৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। সরকারি, বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ সময় ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হতে যাচ্ছে আরো অন্তত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রও রয়েছে। মোট সক্ষমতায় এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হলে চলতি অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা খাতসংশ্লিষ্টদের। বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ ক্রয়ে গত অর্থবছর বিপিডিবির ব্যয় ছিল ৯৫ হাজার ৩১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো (প্রাক্কলিত)। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির ব্যয় হয়েছিল ৭১ হাজার ৪৯৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক অর্থবছরের ব্যবধানে সংস্থাটির ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ৫৬ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পেছনে সবচেয়ে বেশি অর্থ গুনতে হয়েছে বিপিডিবিকে। গত অর্থবছরে বিপিডিবি বেসরকারি (আইপিপি) ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে ৩৪ হাজার ২৫৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে সংস্থাটির অর্থ ব্যয় হয়েছে ৬২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ১৭৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর অর্থ ব্যয় হয়েছিল ৫২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ এক অর্থবছরের ব্যবধানে আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ কম কেনা হলেও ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় বাড়ায় বিপিডিবির গড় উৎপাদন ব্যয়ও ৮ টাকা ৮৪ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৩৩ পয়সায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, জ্বালানি আমদানি ব্যয়, প্রাক্কলন অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ায় সক্ষমতা অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের সবগুলোই এ খাতের ভুল পরিকল্পনার মাশুল। সঠিক প্রাক্কলন ও সময় অনুযায়ী সব কিছু না হওয়ায় এ খাতে আর্থিক ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিদ্যুৎ খাতে প্রতিনিয়ত ব্যয় বাড়তে থাকায় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের ভোক্তা পর্যায়ে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হলেও সামগ্রিকভাবে অর্থ সঙ্কট তৈরি হচ্ছে বিপিডিবির। বিপিডিবির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জ্বালানি আমদানি ও ডলারের মূল্য বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে বিপিডিবির ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি ছিল ১ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৬৫৯ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক এ ক্ষতি থেকে বিপিডিবিকে বের হতে হলে বিদ্যমান ক্রয়চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প নেই। পাশাপাশি পুরনো ও অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে। এটি করা গেলে বিপিডিবির বড় আর্থিক সাশ্রয় হবে বলে মনে করেন বিদ্যুৎ খাতের সাবেক নীতিনির্ধারকরা। এ দিকে গতকাল সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার সাথে পৃথক পৃথক বৈঠকে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
আসন্ন বৈঠকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকির সর্বশেষ অবস্থা এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে আলোচনা হবে। তবে ভর্তুকি সম্পূর্ণরূপে তুলে দেয়ার পরিবর্তে ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার কথা আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানানো হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফের পরামর্শে এরই মধ্যে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধিতি চালু করেছে। ফলে প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করছে। গত মার্চ থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। জানা গেছে, আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংস্কারের জন্য বেশ কিছু শর্ত দিয়েছিল। সেসব শর্ত সরকার কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে তাই পর্যালোচনা করছে প্রতিনিধিদলটি। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে পিডিবির আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল আইএমএফ। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতে যে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে, তা কী করে সমন্বয় করা হবে, সেটিও জানতে চেয়েছেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। গত বছরের অক্টোবরে বিদ্যুৎ-জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সাথে বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। ওই সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি কমানো, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করাসহ আরো বেশ কিছু শর্ত দিয়েছিল প্রতিনিধিদল। এর আগে গেল বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে ৪৭০ কোটি ডলার। এর মধ্যে দুই কিস্তির অর্থ পাওয়া গেছে। তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে অর্থনীতি পর্যালোচনা করতে আইএমএফের মিশনটি এখন বাংলাদেশ সফর করছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা