১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সিয়াম সাধনার মাস

শেষ হচ্ছে সিয়ামের মাস

-

মাহে রমজানুল মোবারকের আজ ২৯ তারিখ। নয়া দিগন্তসহ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আজ থেকে ঈদ উপলক্ষে ছুটি শুরু হয়েছে। আজকের সংখ্যাই ঈদপূর্ব সংখ্যা। তাই পাঠকদের কাছে যাওয়ার সুযোগও আজই শেষ।
মাহে রমজানুল মোবারকে একজন মুসলমানকে নিজের সাধারণ জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও আনুগত্যে এবং তার সন্তুষ্টি অর্জনের ওপর বিশেষ জোর দিতে হয়। আল্লাহর ইবাদতে সাধনার সাথে কিছু বিধি-নিষেধ সহকারে পালন করতে হয় দিন রাতের কর্মসূচি। তারপর ফলস্বরূপ মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। এই সন্তুষ্টির একটি তাৎক্ষণিক আলামত ঈদুল ফিতরের পুরস্কার। এই ঈদকে বলা হয় ঈদুল ফিতর।
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় নিয়োজিত থাকার পর তাতে সমাপ্তি ঘটানো ও দিনের বেলায় পানাহারের স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে যাওয়া উপলক্ষে আনন্দ উপভোগের ব্যবস্থা দিয়েছে ইসলামী শরিয়ত। এটা শুধু অনুমতি নয়, বরং অনেকটা বাধ্যতামূলক নির্দেশ। কেননা শাওয়ালের প্রথম দিনে রোজা রাখাই নিষিদ্ধ। দুই ঈদের দিনে পানাহার করা ও আল্লাহর নিয়ামতের স্বাদ গ্রহণ করা অবশ্য পালনীয় করার তাৎপর্য অনেক।
প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী নির্দিষ্ট দিনে আনন্দ করে থাকে। সাধারণত দেখা যায়, যারা ধনী, তারা আনন্দ-ফুর্তি করে, গরিব-অসহায়রা তা থেকে বঞ্চিত থাকে। কিন্তু ইসলামে ঈদের খুশি শুধু ধনীরা পাবে তা নয়, বরং গরিব-অসহায়রাও ঈদের খুশি ভোগ করবে। তাই ঈদুল ফিতরের সময় ধনীদের ওপর সাদাকাতুল ফিতর অত্যাবশ্যক করা হয়েছে। মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ ঈদ ঈদুল ফিতর। যারা মাহে রমজানকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পেরেছেন, তাদের জন্য ঈদ খুশির বার্তা নিয়ে আসে। সিয়াম সাধনার মাস সফলভাবে সম্পন্ন করার শেষ প্রান্তে উপনীত হওয়া একটি শুভ আলামত। তাই আল্লাহ তায়ালার অপার রহমত ও অনুগ্রহের অধিকারী হওয়ার এবং পাপরাশি থেকে পাকসাফ হয়ে ঈদের আনন্দ ভোগের সুসংবাদ ঘোষণা হতে থাকে রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে।
ঈদের দিনটি আমাদের জন্য আনন্দের দিন। মনের সব কালিমা দূর করে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে, মান-অভিমান বিসর্জন দিয়ে সবাই হাতে হাত মেলানো, বুকে বুক মেলানো, গলায় গলা মেলানো অর্থাৎ সবার দেহ-মন এক হওয়ার আনন্দ হলো ঈদের আনন্দ; নিজের মনের হিংসা, ঘৃণা, লোভ, অহঙ্কার, অহমিকা, আত্মম্ভরিতা, আত্মশ্লাঘা, ক্রোধ, বিদ্বেষসহ যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার আনন্দ। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির আনন্দ।
ইসলামের পাঁচ বুনিয়াদী ইবাদত বা স্তম্ভের অন্যতম রমজানের রোজা। এই পাঁচ রোকন বা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ইসলামের ইমারত। তাই প্রতিটি স্তম্ভেরই সুরক্ষা প্রয়োজন। তাহলেই ইসলামের ইমারত বা কাঠামো বহাল থাকবে। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হওয়ার পাশাপাশি রোজায় রয়েছে অনেক বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য। এগুলো নিয়ে মানুষ যদি সহজাত বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেকের সাথে চিন্তা করে, তাহলে তাতে সে নিজ জীবনের জন্য কয়েকটি উজ্জ্বল দিক দেখতে পাবে। উন্নত মানবীয় মূল্যবোধ চর্চার জন্য নিজের প্রবৃত্তির চাহিদা নিয়ন্ত্রণ ও নিজের চাহিদাও স্বার্থ উপেক্ষা করে আপন প্রভুর বিধান পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। রোজার মাধ্যমে মানুষ একদিকে আধ্যাত্মিক সদগুণাবলিতে সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে। অন্যদিকে অন্যদের দুঃখ-দুর্দশা নিজের অভিজ্ঞতায় এনে নিজের মধ্যে সমবেদনা ও সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে।
রমজানের ২৯ বা ৩০ দিন এমন নূরানী ভাব ও অবস্থায় অতিবাহিত করার পর আসে ঈদুল ফিতরের দিন। এই দিনটি আগমন করে আনন্দ ও ইবাদত এবং স্বস্তি ও গ্রহণযোগ্যতা উভয়কে সাথে নিয়ে। এদিনে থাকে পার্থিব ও পরকালীন উভয় দিক দিয়ে আনন্দের সামগ্রী। একদিকে সে লাভ করে নিজের বৈধ পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী জীবনযাপনের স্বাধীনতা। অন্যদিকে পুরো একমাস আনুগত্য, বাধ্যতা ও ইবাদতের পুরস্কারের সিদ্ধান্ত হয় এবং তাকে রোজার পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এই হিসেবে ঈদের রাতকে লাইলাতুল জায়েযা বা পুরস্কারের রাত নামে আখ্যায়িত করা হয়। রমজানের রোজা যে ব্যক্তি যথানিয়মে পালন করে, রমজান তাকে এমন পবিত্রতা দান করে যা তার সারা বছরের জন্য বরকত ও রহমতের পাথেয় হয় এবং বছর ঘুরে আবার এই বরকতময় মাস আসে। তখন কল্যাণ ও মহিমার এ কর্মসূচি আবার পালনের সুযোগ হয়।
রমজান মাস একজন মুসলমানকে এই উপলব্ধি দান করে যে, এই পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা মানুষ হিসেবে তারই মতো। কিন্তু তাদের অনাহারের কষ্ট ভোগ করতে হয়। এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের কাছে মানবীয় চাহিদাগুলো পূরণের সামগ্রী নেই। রমজান আরো বলে দেয়, মানুষের উচিত তার চারপাশে বসবাসকারী ও স্বজাতির দুঃখকষ্ট অনুভব করা এবং তাদের প্রতি যথাসম্ভব সমবেদনা অনুভব করা। এজন্য অভাবীদের সহায়তা ও ক্ষুধার্তকে আহার করানো রমজানের অত্যন্ত প্রিয় কাজগুলোর অন্তর্গত সাব্যস্ত করা হয়েছে। মানুষ যখন রোজা রেখে ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করে তখন সে নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারে ক্ষুধা কী এবং অনাহারী মানুষদের প্রতি সমবেদনা কত উন্নত আচরণ। রোজা রেখে সে যখন প্রবৃত্তির বিভিন্ন চাহিদা পূরণ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে বাধ্য হয়, তখন সে নিজেকে সেসব মন্দ কাজকর্ম থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগ পায় যেগুলো উন্নত জীবন পদ্ধতির সাথে বেমানান ও নিন্দনীয়। এভাবে রমজান আসে মানুষকে সৎ, সজ্জন ও পবিত্র বানানোর কর্মসূচি নিয়ে। এই কর্মসূচি মানুষের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এতে রয়েছে মানুষের উন্নতি ও কল্যাণের পাশাপাশি মহান প্রভুর সন্তুষ্টি ও প্রীতি লাভের ব্যবস্থা। রমজানের সিয়াম পালনের প্রথম পুরস্কার ঈদুল ফিতরের আনন্দ এবং প্রকৃত পুরস্কার মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার পক্ষ থেকে বিশেষ প্রতিদান।
ঈদের দিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, মিসওয়াক করা, মহল্লার (এলাকার) মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়া, গোসল করা, সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন পোশাক পরিধান করা, আতর ব্যবহার করা, নামাজের আগে সদাকাতুল ফিতর আদায় করা, ঈদুল ফিতর নামাজের আগে কিছু মিষ্টান্ন খাওয়া, তিন, পাঁচ বা বেজোড়সংখ্যক খেজুর বা খুরমা খাওয়া, সকাল সকাল ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাওয়া, ঈদের নামাজ ঈদগাহে গিয়ে পড়া সম্ভব না হলে মহল্লার মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়া, আস্তে আস্তে নিম্নলিখিত দোয়া পড়তে পড়তে ঈদগাহে যাওয়া- আল্লাহু আকবার, আল্লøাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ, ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া, এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা, শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে খুশি প্রকাশ করা প্রভৃতি ঈদের সুন্নত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তার সুসংবাদের অধিকারী করুন। প্রকৃত খুশি ও উভয় জগতের কল্যাণ আমাদের নসিব করুন। সবাইকে ঈদ মোবারক।


আরো সংবাদ



premium cement