রুমার পরে থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে কেএনএফের হানা
- মিনারুল হক রুমা থেকে ফিরে
- ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫
বান্দরবানের রুমা উপজেলার ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যরা থানচির সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে হানা দিয়ে টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। গতকাল বুধবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ১৫ থেকে ২০ জনের সন্ত্রাসীরা একটি গাড়ি করে এসে হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা ও কৃষি ব্যাংক থেকে দুই লাখ ৪৫ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় তারা বাজারে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। থানচি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মামুন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ দিকে এ ঘটনার পর থানচি বাজারে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে ব্যাংকে ঢোকার পর পরই বাজারে বিজিবি ও পুলিশ এসে পড়লে সন্ত্রাসীরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ঠিক এমন একটি সময়ে এ ঘটনা ঘটল যখন রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকে লুটপাটের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি রুমা উপজেলা সদরে প্রবেশের আগ মুহূর্তেই এ ঘটনা ঘটে।
ঘটনার পর রুমা ও থানচি উপজেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ দু’টি উপজেলায় সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বান্দরবানের প্রতিটি ব্যাংক ও এটিএম বুথে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আপাতত লেনদেন বন্ধ রয়েছে সোনালী ব্যাংকগুলোতে। পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন রুমা পরিদর্শনের সময় তার সাথে বান্দরবানের সেনাবাহিনীর রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মেহেদী হাসান, জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন, বিজিবির সেক্টর কমান্ডার, চট্টগ্রাম পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান, বান্দরবানের পুলিশ সুপার মো: সৈকত শাহীনসহ বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আনসার ভিডিপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কোনো সন্ত্রাসীকেই ছাড় দেয়া হবে না : পুলিশের মহাপরিদর্শক ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, কোনো সন্ত্রাসীকেই ছাড় দেয়া হবে না। যারা ব্যাংকে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। এলাকার মানুষের নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে পুলিশের মহাপরিদর্শক জানিয়েছেন।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকে কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যরা সোনালী ব্যাংকে হানা দিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ও চার শতাধিক গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় আহত হয় পুলিশ ও আনসারের ছয় সদস্য। রাতে এ ঘটনার সময় ব্যাংকের ভল্টে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা ছিল বলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে সন্ত্রাসীরা ভল্টের টাকাগুলো নিয়ে যেতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার পরিদর্শন শেষে জানিয়েছেন ভল্টের দরজার বেশ কিছু অংশ ভাঙা ছিল। সোনালী ব্যাংক পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে কম্পিউটার ও আসবাবপত্র ভাঙা রয়েছে। গতকাল পুলিশের পিবিআই সিআইডি ও ক্রাইম সিনের সদস্যরা বিকেল পর্যন্ত তদন্ত করছিলেন।
ম্যানেজারের খোঁজ মেলেনি : অপহৃত রুমা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি। ব্যাংকে হামলার পর সন্ত্রাসীরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। রাতে এ ঘটনার পর পুরো রুমা উপজেলায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ব্যাংক ম্যানেজার উদ্ধারে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। এ দিকে ঘটনার প্রতিবাদে রুমা উপজেলার সাথে বান্দরবানের সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ম্যানেজারের মুক্তির দাবিতে রুমা উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গতকাল উপজেলা প্রাঙ্গণ মানববন্ধন করেছে। তারা অবিলম্বে ম্যানেজারকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছে।
ঘটনার পর বান্দরবানের রুমা উপজেলায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সন্ধ্যার আগেই বাজারের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। অন্য দিকে থানচিতেও চলছে একই অবস্থা। এ দু’টি উপজেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। যেকোনো সময় সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা আরো বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে এ আশঙ্কায় সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ সেনাবাহিনী আনসার বাহিনীর বাড়তি সদস্য বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা হয়েছে উপজেলায়।
সোনালীর রুমা শাখায় টাকা লুট হয়নি : বান্দরবানের রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে কোনো টাকা লুট হয়নি। ওই ব্যাংকের ভল্টে থাকা সব টাকা অক্ষত আছে। গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ গণমাধ্যমকে এ কথা জানান।
শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, সিআইডির চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ইউনিটের দু’টি দল রুমায় গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। পরে ব্যাংকের ভল্ট খুলে সব টাকা গুণে দেখা হয়। দেখা যায় যে গত মঙ্গলবার রাখা এক কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকার পুরোটাই সেখানে রয়েছে। তিনি আরো বলেন, দু’টি চাবি একসাথে দিয়ে ভল্ট খুলতে হয়। কোনো কারণে অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা হয়তো ভল্ট খুলতে পারেনি।
কেন হঠাৎ ব্যাংকে হামলা : মঙ্গলবার ও বুধবার বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার তিনটি ব্যাংকে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ এ হামলায় জড়িত ছিল বলে স্থানীয়রা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। গত ৫ মার্চ কেএনএফের সন্ত্রাসী তৎপরতা দমনে শান্তি কমিটির সাথে রুমা উপজেলা সদরে সমঝোতা বৈঠক হয়। এর আগে গত বছরের ৫ নভেম্বর প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকগুলোতে কেএনএফ আর কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়াবে না মর্মে সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কিন্তু দ্বিতীয় বৈঠকের এক মাস যেতে না যেতেই রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকে হামলা করেছে কেএনএফ। একই সাথে তারা থানচি উপজেলায় দু’টি ব্যাংকে হামলা চালায় তারা।
পাঁচ-ছয় মাস আগে কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতার সময় তারা রোয়াংছড়িতে ব্যাংকে হানা দেবে এরকম একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। এ ধরনের হামলার আলোচনার পর ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়নি বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে দ্বিধাবিভক্ত কেএনএফের একটি পক্ষ ব্যাংকে আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। দলটির সাথে মিয়ানমার থেকে আসা অন্য একটি সন্ত্রাসী দলের বেশ কিছু সদস্য ছিল বলে জানা গেছে। এসব ঘটনা নিয়ে শান্তি আলোচনা চলমান থাকবে কি না তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। মূলত কেএনএফের বিবদমান দু’টি পক্ষ শান্তি আলোচনা পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। শান্তি আলোচনা নস্যাৎ এবং শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবেই ব্যাংকগুলোতে আক্রমণ চালানো হয়েছে বলে একাধিক সূত্র বলছে।
অন্য দিকে ব্যাপক আর্থিক সঙ্কটে ভোগা কেএনএফ তাদের সংগঠনের আর্থিক সঙ্কট মেটাতেই ব্যাংকগুলোতে হামলার পরিকল্পনা করেছিল বলে একাধিক সূত্র বলছে। তবে এসব ঘটনা নিয়ে এখনো কেএনএফের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের ফেসবুক পেজেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।
এলাকার পরিস্থিতি ও প্রশাসনের বক্তব্য : কেএনএফ শান্তি আলোচনা চালালেও তারা রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক চাঁদাবাজি চালাচ্ছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। কাঠ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ঠিকাদার, সবজি ব্যবসায়ী, পরিবহন ব্যবসায়ী কোনো কিছু বাদ যাচ্ছে না এদের কাছ থেকে। এ সংগঠনটি তৎপরতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এলাকার স্থানীয়রা আতঙ্ক উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে হামলার পর শান্তি আলোচনা অব্যাহত থাকবে কি না তা নিয়ে এখন এলাকায় ব্যাপক আলোচনা চলছে। কেএনএফের সন্ত্রাসী তৎপরতা কমিয়ে আনতে গঠন করা শান্তি কমিটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হতে পারে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। কেএনএফের হামলার বিষয়ে এখনো শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেন হয় এমন প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। যেসব ব্যাংকগুলোতে লেনদেনের ঝুঁকি রয়েছে সেসব লেনদেন আপাতত বন্ধ করে রাখার জন্য বলা হয়েছে। অন্য দিকে সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলে অবহিত করা হয়েছে। উপজেলাগুলোতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জনসাধারণের নিরাপত্তায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার মো: সৈকত শাহীন জানিয়েছেন, উপজেলা গুরুতে জনসাধারণের নিরাপত্তায় সেখানে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা