০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

বিএনপিকে দুর্বল করতে নানা তৎপরতা

-

- আলোচনায় আবারো মেজর হাফিজ, তৎপর ‘তৃণমূল বিএনপি’
- কারাগারেও যেতে পারে সমঝোতার প্রস্তাব

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত সোমবার দলের এক আলোচনা সভায় দু’টি তথ্য দিয়েছেন। এক. বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে নতুন দল হচ্ছে। দুই. তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিতে অনেকেই লাইন ধরে আছে। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর আজ বিএনপির সাবেক দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক দল ‘তৃণমূল বিএনপি’ জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি যোগদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। দলটি জানিয়েছে, নেতাকর্মী ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ অনেকে তাদের দলে আজ যোগ দেবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর আন্দোলনে থাকা বিএনপিকে ‘দুর্বল’ করতে এ ধরনের তৎপরতা শুরু হতে পারে। তারা এও বলছেন, কারাগারে আটক বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিতে আগামী দিনে নানা প্রস্তাবও দেয়া হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী এ বিষয়ে বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে বিএনপিকে ভাঙা ও নেতাদের একটি অংশকে নিবাচনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দলটি থেকে বড় কোনো নেতা বের হয়ে যাননি কিংবা অন্য কোনো দলে যোগদান করেননি অথবা কেউ এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেননি যেটা বিএনপির জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হবে। মেজর হাফিজসহ কয়েকজনের নাম অনেক আগে থেকেই শোনা গিয়েছিল। তারা হয়তোবা অন্য একটি পার্টি তৈরি করে ওই পার্টির মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এ জন্য তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএম নামে দু’টি পার্টি তৈরি হয়েছে। মেজর হাফিজকে নিয়ে অনেক আগে থেকে বিতর্ক আছে। হয়তো ঝোপ বুঝে কোপ মারার একটা পরিকল্পনা তিনি করতে পারেন।

‘দল ছাড়া এবং আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন’, এ রকম নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। বিএনপি নির্বাচনে গেলে আমি সেই নির্বাচনে অংশ নেবো।’ আপনি নতুন দল করছেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে সরকারের মন্ত্রীরা দাবি করছেন এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমি দেখছি।’
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নেমে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে বিএনপি। সিনিয়র থেকে জুনিয়র বলতে গেলে সব নেতাই কারাগারে। এমন পরিস্থিতিতেও দলটি আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। আন্দোলনকে তারা খুব কম সময়ের মধ্যে একটা যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চান।
রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে, দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা কারাগারে থাকায় নির্বাচনকে ঘিরে সেখানে কোনো পক্ষ সমঝোতার প্রস্তাব দিতে পারে। অথবা কিছু নেতাকে নির্বাচনে নিয়ে আসার চেষ্টাও হতে পারে।

তবে বিএনপির হাইকমান্ড বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। চলমান আন্দোলনে শিগগিরই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।
বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, দীর্ঘ দিন ধরে বিএনপিকে ভাঙার নানা তৎপরতা চলছিল। নির্বাচন সন্নিকটে আসায় এবং বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় এই তৎপরতা এখন জোরালো হতে পারে। বিএনপিকে চাপে ফেলে দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টাও হতে পারে ।

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের সাথে নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংর্ঘষ হয়। এরপর দিন ২৯ অক্টোবর প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর একে একে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, তিন ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও মজিবর রহমান সরোয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ও বিলকিস জাহান শিরীন এবং কেন্দ্রীয় নেতা জহির উদ্দিন স্বপনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গ্রেফতার করা হয় আরেক যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকে।

দলটির দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে মহাসমাবেশের কয়েকদিন আগে থেকে এ পর্যন্ত ১৪৮টির অধিক মামলায় প্রায় ৯ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিএনপির কোনো কোনো নেতা বলছেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারের ওপর বিদেশী চাপ অব্যাহত রয়েছে। তাই চূড়ান্ত আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পর্দার অন্তরালে নানা ধরনের তৎপরতা চলছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় সেটি আরো জোরালো হয়েছে। কিছু নেতাকে বিএনপির বিকল্প বানিয়ে নির্বাচনে নেয়ার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বাদ দিয়েও বিএনপিকে নির্বাচনে নেয়া যায় কি না সে প্রক্রিয়া চলছে।
বিএনপির নেতারা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ, সুসংগঠিত। যতই চাপ প্রয়োগ করা হোক, কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না। শীর্ষ নেতৃত্বকে মাইনাস করে কোনো নির্বাচনে তারা যাবেন না। সুতরাং সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। এক দফার চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তাদের ধারণা, বর্তমান পরিস্থিতিতেও কূটনৈতিক তৎপরতা থেমে নেই। ফলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।

অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী আরো বলেন, ‘সরকারের সাথে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের অনেকে যোগাযোগ করছে বলে দীর্ঘ দিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন আলোচনা আছে। তা ছাড়া আমার মনে হয়, আপসের নানা প্রস্তাব চলবে। বাংলাদেশে আপসের রাজনীতি হয়, অতীতে সেটি দেখা গেছে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপির গ্রহণযোগ্য নেতাদের কেউই এতে কোনো উৎসাহ দেখাবেন না।
নুরুল আমিন বেপারী বলেন, বিএনপিতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্ব এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, তাদেরকে মাইনাস করে কোনো কিছু করা যাবে না। কোনো নেতা দল ছেড়ে চলে গেলেও কাউকে সাথে পাবেন না। তারেক রহমান তার নেতৃত্ব তৃণমূলে দারুণভাবে বিস্তার লাভ করিয়েছেন, এখানেই তার সাথর্কতা। তিনি দলে তৃতীয় স্তর পর্যন্ত নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছেন। স্থায়ী কমিটিসহ প্রথম পর্যায়ের নেতারা গ্রেফতার হয়ে গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতাদের মাধ্যমে তিনি কমসূচি পালন করাবেন। তৃতীয় পর্যায় পর্যন্ত মনে হয় যাওয়া লাগবে না।

এ দিকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় চলতি সপ্তাহে আজ বুধবার থেকে দেশব্যাপী ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি শুরু হচ্ছে, যা আগামী শুক্রবার সকাল ৬টায় শেষ হবে। তৃতীয় দফার এই অবরোধ শেষে শুক্র ও শনিবার বিরতি দিয়ে আগামী সপ্তাহের প্রথম দুই দিন হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। ওই কর্মসূচি শেষে এক দিন বিরতি দিয়ে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কিংবা হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। অবরোধে মিছিলের পাশাপাশি পিকেটিং বাড়াতে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে এর পরের সপ্তাহে কী কর্মসূচি দেয়া যায়, তা নিয়ে ভাবছেন নীতিনির্ধারকরা। যুগপৎ শরিকদেরও মতামত চাওয়া হয়েছে।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, ২৮ অক্টোবর সরকার পরিস্থিতি তৈরি করে বিএনপিকে হরতাল-অবরোধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন তফসিল ঠেকাতে হলে বড় কর্মসূচি চালাতে হবে। নেতাদের কারো কারো মতে, টানা অবরোধ চালিয়ে যেতে হবে। মাঝে মাঝে হরতাল দেয়া যেতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement