সস্তা বিদেশী ঋণে বড় চাপ
৭৯ টাকার ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা, ৯ বছরে ডলার বিনিময়জনিত ক্ষতি হয়েছে ৩৯ শতাংশ- আশরাফুল ইসলাম
- ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রায় সাড়ে আট কোটি ডলারের বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ অনুমোদন হয়। এর মধ্যে একটি অংশ ছিল সাত বছর মেয়াদি। ঋণের একটি অংশ এখনো পরিশোধ হয়নি। ওই সময় প্রতি ডলার পেতে ব্যয় হতো ৭৯ টাকা ১০ পয়সা। মঞ্জুরিকৃত এসব ঋণের সুদের হার ছিল ৬ শতাংশের মধ্যে। যখন স্থানীয় বাজারে ব্যাংক ঋণ পেতে ব্যয় হতো ১২ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত। বিদেশ থেকে সস্তায় এসব ঋণ পেয়ে অনেকেই আত্মতুষ্টিতে ছিলেন। অনেকেই এসব ঋণের বাহবাও দিতেন। কিন্তু সস্তায় এসব ঋণ এখন জাতির ঘাড়ে বড় চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দিকে ডলার সঙ্কটের কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে সস্তা এসব ঋণ, বিপরীতে এসব ঋণ পরিশোধে নাভিশ্বাস উঠেছে উদ্যোক্তাদের। কারণ, ঋণ মঞ্জুরের সময় প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় হতো ৭৯ টাকা ১০ পয়সা, আট বছরের মাথায় প্রতি ডলারে ব্যয় হচ্ছে ব্যাংকভেদে ১১০ টাকা। আলোচ্য সময়ে শুধু ডলারের বিনিময় হার জনিত ক্ষতি হয়েছে প্রতি ডলারে ৩১ টাকা বা ৩৯ শতাংশ। আর এর সাথে ৬ শতাংশ সুদ যুক্ত করলে উদ্যোক্তাদের সুদ দিতে হচ্ছে ৪৫ শতাংশ। আর এতেই কাহিল হয়ে পড়েছেন কিছু উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের ঋণের তথ্য সর্বশেষ হালনাগাদ করেছে গত মার্চ মাস ভিত্তি ধরে। এরপরে বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের তথ্য আর হালনাগাদ করা হয়নি। বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বা আড়াই হাজার কোটি ডলার। এর মধ্যে এক হাজার ৭০৭ কোটি ডলার স্বল্প মেয়াদে, যা এক বছরের নিচে। আর বাকি ৭৯১ কোটি ১২ লাখ মার্কিন ডলার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এসব ঋণের সুদ আপাতত কম মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব পড়বে দেশের ওপর। আর সামগ্রিকভাবে চাপ বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদেশ থেকে সরাসরি ব্যবসায়ীরা যে ঋণ নিচ্ছেন সেগুলো হলো সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট হলো হার্ড লোন। অর্থাৎ এ ঋণের সুদ নির্ধারণ হয় বাজার রেটে। এ কারণে এসব ঋণের সুদ তুলনামূলকভাবে বেশি। আবার এসব ঋণ নেয়া হয় বিদেশী মুদ্রায়, পরিশোধও করা হয় বিদেশী মুদ্রায়। সুতরাং এসব ঋণ বেশি হলে দেশের ওপর চাপ বাড়ে। এ কারণে এসব ঋণ সীমার মধ্যে রাখাটাই দেশের জন্য ভালো ছিল।
কিন্তু দেশীয় উদ্যোক্তারা বিদেশী এসব ঋণের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েন।
বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বিদেশী ঋণের দিকে কেনো ঝুঁকে পড়েছিলেন, এ বিষয়ে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ২০১০ সালে পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারির পর ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। স্থানীয় মুদ্রাবাজার থেকে ঋণ নিতে উদ্যোক্তাদের ১৫ শতাংশ সুদ গুনতে হতো। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ ও দেশীয় ব্যাংক থেকে টাকা না পাওয়ায় ২০১০ সালের পর বিদেশী ঋণ আনার ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য অনেকটা শিথিল করা হয়। আর এর পর থেকেই ব্যবসায়ীরা বিদেশী ঋণে উৎসাহিত হয়ে পড়েন। তবে ২০১৩ সালের পর থেকে বিনিয়োগে ভাটা পড়ায় ব্যাংক ঋণের চাহিদা কম ছিল। ব্যাংকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগযোগ্য তহবিল ছিল। ব্যাংক ঋণের সুদহারও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। গত কয়েক বছর যাবৎ ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের নিচে রয়েছে। কিন্তু একশ্রেণীর বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিদেশী ঋণ আনা বন্ধ করেনি; বরং দিন দিন বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এ সুবাদে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের স্থিতি মার্চ শেষে ২৫ বিলিয়ন ডলারে এসে ঠেকেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, একসময়ে ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে যেসব ঋণ নিয়েছিলেন ওই সব ঋণের সুদ কম হলেও বর্তমানে কার্যকর হার অনেক বেড়ে গেছে। কেননা, বিদেশী মুদ্রায় নেয়া এসব ঋণ টাকায় ব্যয় হচ্ছে; কিন্তু পরিশোধ করতে হবে বিদেশী মুদ্রায়। এতে চাপ বেড়ে গেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
বর্তমানে ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে শুধু সরকারি কিছু কেনাকাটায় ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করছে। অন্য ব্যাংকগুলোর অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। প্রতি নিয়তই ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। এরই মধ্যে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৭ বিলিয়নে নেমে এসেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এরই মধ্যে প্রতি ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট ১২০ টাকা উঠে গিয়েছিল; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত অবস্থানের কারণে ১১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। যদিও বিভিন্ন করপোরেট ডিলিংসহ বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে কার্যকর ডলারের দর আরো বেশি রয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এসব বিদেশী ঋণ এখন গলার কাঁটা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তারা বেশি টাকা দিয়ে ডলার কিনে পরিশোধ করছেন। অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে মেয়াদ বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এতে গুনতে হচ্ছে বাড়তি সুদ। সবমিলেই বড় ধরনের চাপেই ফেলা হয়েছে সস্তা এসব বিদেশী ঋণ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা