৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গ্যাস গ্রাহকদের বাড়তি পরিশোধ করতে হচ্ছে ২২০০ কোটি টাকা

-

গ্যাস ব্যবহার না করেই তিতাসসহ ছয় বিতরণ কোম্পানির আবাসিক গ্রাহকদের বছরে পরিশোধ করতে হচ্ছে বাড়তি প্রায় ২২ শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিতাসের গ্রাহকরাই বাড়তি পরিশোধ করছে দেড় হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গ্যাস ব্যবহারের তুলনায় মাসে একজন আবাসিক গ্রাহক প্রায় ৪৭৫ টাকা বাড়তি পরিশোধ করছেন। অতিরিক্ত এই টাকা জমা হচ্ছে গ্যাস বিতরণে নিয়োজিত তিতাসসহ ছয়টি কোম্পানির কোষাগারে। বিপরীতে প্রিপেইড মিটার বসিয়ে তিতাসসহ আলোচ্য কোম্পানি প্রতি বছর রাজস্ব হারাচ্ছে ২০৪ কোটি টাকা। সব গ্রাহককে মিটারের আওতায় আনা হলে বছরে শুধু বিল বাবদ রাজস্ব হারাবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। আর মিটার বসাতে এককালীন ব্যয় হবে আরো ১০ হাজার কোটি টাকা।
আবাসিক গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রতিবেদন ও একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে। ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিতাসের দুই লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। এজন্য প্রতি মিটার বাবদ খরচ হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে তিতাসের সাড়ে ২৮ লাখ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। এ হিসাবে সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে ব্যয় হবে সাত হাজার ১২৫ কোটি টাকা। বিপরীতে প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে ৪৭৫ টাকা কম বিল পেলে বছরে রাজস্ব হারাবে প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এত গেলো শুধু তিতাসের রাজস্ব ক্ষতি ও ব্যয়ের হিসাব। আর তিতাসসহ ছয় সরবরাহ কোম্পানির ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৮০৯ জন আবাসিক গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে ব্যয় হবে ১০ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। আর বছরে শুধু বিল বাবদ রাজস্ব হারাবে ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা।
যেভাবে বিল নির্ধারণ করা হয় : বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো পাইপলাইনের গ্রাহকদের কাছ থেকে মাসিক বিল ধার্য করে। এ ক্ষেত্রে সিঙ্গেল বার্নার (এক চুলা) থেকে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ যে পরিমাণ গ্যাস বের হওয়া সম্ভব তার পুরোটা ধরা হয়। এভাবে এক চুলায় দৈনিক ১০ ঘণ্টা এবং দুই চুলায় দৈনিক আট ঘণ্টা জ্বলার হিসাবে ২৬ দিন দিয়ে গুণ করা হয়। এর সাথে ‘ডাইভারসিটি ফ্যাক্টর’ গুণ করে সঞ্চালন ও বিতরণ মাশুল এবং মূল্য সংযোজন কর, ভ্যাটসহ মোট গ্যাস বিল নির্ধারণ করা হয়। এখন মিটারযুক্ত কোনো গ্রাহক যদি দৈনিক ১০ ঘণ্টার স্থানে পাঁচ ঘণ্টা চুলা জ্বালায় তার গ্যাস খরচ স্বাভাবিকভাবেই অর্ধেক কমে যায়। বর্তমানে আবাসিক খাতে এক চুলায় প্রতি মাসে বিল ৯২৫ টাকা এবং দুই চুলায় ৯৭৫ টাকা। প্রিপেইড মিটারের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১২ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। সে হিসাবে পাইপলাইনের দুই চুলার একজন গ্রাহক মাসে ৭৭ দশমিক ৩৮ ঘনমিটার গ্যাসের বিল দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে একজন গ্রাহক মাসে সর্বোচ্চ গ্যাস ব্যবহার করেন ৩৯ মিটার। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো বিল নির্ধারণ করে ৭৭ দশমিক ৩৮ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার ধরে। এতে দেখা যায়, মিটার সংযোজনকারী একজন গ্রাহক মাসে সর্বোচ্চ বিল দিচ্ছে ৪৯২ টাকা, বিপরীতে মিটারবিহীন একজন গ্রাহককে মাসে বিল দিতে হচ্ছে ৯৭৫ টাকা।
এনালগ মিটার লাগানোর প্রক্রিয়া ভণ্ডুল : তিতাসের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে আলাপ করে জানা গেছে, একটি উল্লেখযোগ্য আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে আশির দশকে এনালগ মিটার চালু করা হয়েছিল। ছয় মাসের মধ্যে তিতাসের আয় তখন ব্যাপকভাবে কমে যায়। তখন রাজস্ব ধস ঠেকাতে সরাসরি না গিয়ে বিকল্প উপায়ে এনালগ মিটারে গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। আবাসিক গ্রাহকদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট রেটে অর্থাৎ নির্ধারিত হারে বিল সংগ্রহ করা হতো। এজন্য প্রতিটি এলাকার জন্য একজন বিল সংগ্রহকারী ছিল। কিন্তু যখন এনালগ মিটার চালু করা হয়, তখন দুইজন লোকবল নিয়োগ দিতে হলো। মিটার মেরামতের জন্য একজন এবং বিল সংগ্রহকারী আরেকজন। এতে বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগ দিতে হয় তিতাসকে। ফলে তিতাসের ব্যয় রাতারাতি বেড়ে যায়। পাশাপাশি মিটারের অবচয় ব্যয়ও আবাসিক খাতের রাজস্বের ওপর চাপে। সবমিলে একটি বড় অঙ্কের ব্যয় তিতাসকে বহন করতে হয়। এক দিকে বেড়ে যায় ব্যয়, বিপরীতে কমে যায় রাজস্ব আয়। সবমিলেই বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় তিতাস। এ থেকে বের হওয়ার জন্য বিকল্প কৌশল অবলম্বন করা হয়। যখনই কোনো মিটার খারাপ হয়, তখন সেটা মেরামত না করে নির্ধারিত হারে অর্থাৎ ফ্ল্যাট রেটে বিল দিতে গ্রাহককে উৎসাহিত করা হয়। এভাবে এক পর্যায়ে তিতাস আবার পুরোপুরি আগের জায়গায় ফিরে আসে।
অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে আবার একই ভুল : তিতাসের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে আবার একই ভুল করে বসেছে নীতিনির্ধারকরা। কারণ প্রতি মাসে যেভাবে গ্রাহকের বিল নির্ধারণ করা হয় বাস্তবে একজন গ্রাহক মাসে তার চেয়ে কম গ্যাস ব্যবহার করে। যখন মিটারের আওতায় আনা হয়, তখন গ্রাহক প্রকৃত ব্যবহারের ওপরই বিল পরিশোধ করে। ফলে রাজস্ব আয় কমে যায় রাতারাতি।
বর্তমানে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের যেসব প্রকল্প : গ্যাসের অপচয় রোধ, গ্রাহকসাশ্রয়ী ও সিস্টেম লস কমাতে ২০১৬ সালে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হয়। প্রথমে জাইকার অর্থায়নে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই লাখ গ্রাহককে এ মিটারের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়। ওই আলোকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (তিতাস) ২০১৬ সালে লালমাটিয়া এলাকায় প্রথম পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু প্রিপেইড মিটার স্থাপন করে। তখন দেখা যায়, গ্রাহকভেদে প্রিপেইড মিটারে বিল আসছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। সে সময় মিটারবিহীন গ্রাহকের ডাবল বার্নারে (দুই চুলা) মাসিক বিল ছিল ৬৫০ টাকা। পরে দুই চুলার জন্য গ্যাসের বিল বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা এবং এক চুলার জন্য ৯২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালে বিইআরসি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণায় প্রিপেইড মিটার স্থাপনের আদেশ জারি করে। এরপর বিতরণ কোম্পানিগুলো কাগজে-কলমে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু করে। পেট্রোবাংলার অধীনে ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির আবাসিক গ্রাহকসংখ্যা ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৮০৯টি। এ পর্যন্ত প্রিপ্রেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে তিন লাখ ৫৮ হাজার ৪৩২টি। অবশিষ্ট ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৭ জন গ্রাহক এখনো পাইপলাইন থেকে সরাসরি গ্যাস ব্যবহার করছে।
তিতাসের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জাইকার অর্থায়নে তিন লাখ ২০ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া আর্থিক সহযোগিতার লক্ষ্যে সাড়ে ১৬ লাখ মিটার স্থাপনের তিনটি প্রকল্প দাতা সংস্থার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম প্রকল্পে ৮৩০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে চার লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হবে। একই সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় প্রকল্পের অধীনে এক হাজার ৮৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হবে। আর তৃতীয় প্রকল্পটিতে স্থাপন করা হবে সাত লাখ প্রিপেইড মিটার। ব্যয় হবে এক হাজার ৪৭৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। তিনটি প্রকল্পে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে আরো এক লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের লক্ষ্যে প্রাক্কলন ও এলাকা নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (টিজিটিডিসিএল) আবাসিক গ্রাহক ২৮ লাখ, ৫৬ হাজার, ২৪৭ জন। এ ছাড়া কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) আবাসিক গ্রাহক পাঁচ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৫, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিডিসিএল) দুই লাখ ৩৮ হাজার ৫৯১, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (জেজিটিডিসিএল) গ্রাহক দুই লাখ ১৯ হাজার ৭৭০, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (পিজিসিএল) গ্রাহক এক লাখ ২৮ হাজার ৮৪৪ এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিসিএল) আবাসিক গ্রাহক দুই হাজার ৩৭২ জন।


আরো সংবাদ



premium cement
নোটিশ পৌঁছানোর আগেই ইজারা সম্পন্ন, ঠিকাদারদের ক্ষোভ কুশিয়ারা নদীর বালু উত্তোলনের ফলে রাস্তায় ভাঙন রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তি দল বা গোষ্ঠীর নয় : জাতীয় নাগরিক কমিটি ব্যাংকারস অ্যাসোসিয়েশন সাতক্ষীরার র‌্যালি ও আলোচনা সভা শায়েস্তাগঞ্জ ও গৌরনদীর ৫৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই গণহত্যায় জড়িত শেখ পরিবারের কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি স্বামীর পর শ্বশুরবাড়ির ঠাঁইটুকুও হারালেন শহীদ জোবায়েরের স্ত্রী খুবিতে জুলাই বিপ্লবের আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরু সমাবর্তন ছাড়াই মূল সনদপত্র পাবেন বাকৃবি শিক্ষার্থীরা জুড়ীর কন্টিনালা নদীতে পলো উৎসব জামালপুরে বেসরকারি হাসপাতাল ও বিএনপি কার্যালয়ে হামলা

সকল